ছোটবেলায় জীবনবিজ্ঞানে আমরা পড়েছি, মানুষের শরীর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ধমনী (আর্টারি) ও শিরা (ভেন)। ধমনী অক্সিজেনেটেড ব্লাড বা বিশুদ্ধ রক্ত শরীরের বিভিন্ন টিসুতে ছড়িয়ে দেয়। এই রক্তের রং লাল। আর শিরা বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে নীল রঙের ডিঅক্সিজেনেটেড ব্লাড বা দূষিত রক্ত হৃদ্যন্ত্রে নিয়ে আসে। প্রসঙ্গত, দু’ধরনের শিরা রয়েছে মানবদেহে। এক ধরনের শিরা থাকে ত্বকের কাছাকাছি (সুপারফিশিয়াল ভেন), অন্যটা গভীরে (ডিপ ভেন)। আর পারফোরেটর ভেন বাইরের সঙ্গে ভিতরের শিরাকে যুক্ত করে। এই শিরাগুলির মাধ্যমে সুপারফিশিয়াল ভেন থেকে রক্ত ডিপ ভেনে পৌঁছয়।
পায়ের পিছনে (ইংরেজিতে কাফ বলা হয়) বিশেষ ধরনের ডিপ ভেন থাকে। বিভিন্ন কারণে এই ভেনে রক্ত জমাট বেঁধে গেলে, তাকে বলে ডিপ ভেন থ্রমবোসিস (ডিভিটি)। বেশির ভাগ সময়ে কাফের ডিপ ভেনেই ডিভিটি হয়ে থাকে। জমাট বাঁধা রক্তের দলাকে বলা হয় থ্রম্বাস আর জমাট বাঁধার পদ্ধতিটির নাম থ্রম্বোসিস। ডিভিটি থেকে নানা গুরুতর রোগ বা সমস্যা হতে পারে, যার দু’একটি প্রাণঘাতীও। এই রোগের লক্ষণ, সমস্যা ও তার নিরাময় নিয়ে আলোচনা করলেন কার্ডিয়োথোরাসিক সার্জন ভবতোষ বিশ্বাস।
রোগের লক্ষণ
বেশিক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসে থাকলে অনেকের পা ফুলে যায়। এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু যদি অল্প সময়ের মধ্যে পা ফোলে, সঙ্গে মৃদু যন্ত্রণা হয়, সেখানে ত্বক লালচে হয়ে যায়, তা হলে এগুলোকে ডিপ ভেন থ্রম্বোসিসের লক্ষণ বলেই ধরে নেওয়া হয়। ডা. বিশ্বাস বললেন, ‘‘ডিভিটি-র অন্যতম লক্ষণ হল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পা ফোলা। সেটা হঠাৎ করে অথবা ধীরে ধীরেও হতে পারে। যে জায়গাটা ফুলছে, সেই জায়গায় আঙুল দিয়ে চাপ দিলে সেটা ঢুকে যাবে। তা ছাড়া, ফোলা অংশটা সামান্য গরমও হতে পারে।’’
কেন হয় ডিভিটি?
ডিভিটি হওয়ার প্রধান কারণ, শিরায় রক্তপ্রবাহের বেগ কমে যাওয়া অথবা রক্তের স্বাভাবিক জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ার সমস্যা। ষাট বা তার বেশি বয়সের ব্যক্তিদের মধ্যে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশি। যদিও কম বয়সের মানুষদেরও এই সমস্যা হতে পারে। যেমন, যাঁদের দীর্ঘক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয় বা যাঁরা অনেকক্ষণ একনাগাড়ে গাড়ি চালান, তাঁরাও ডিভিটি-তে আক্রান্ত হতে পারেন।
প্যারালিসিসের মতো শারীরিক অসুস্থতা বা অস্ত্রোপচারের কারণে যাঁদের বহু দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়, তাঁদের পায়ের শিরায় রক্তপ্রবাহের গতি কমে যাওয়ার ফলে হতে পারে এই রোগ।
এ ছাড়াও আছে অন্যান্য কারণ। যেমন, গর্ভাবস্থায়, বিশেষত অ্যাডভান্সড স্টেজে পেটের শিরার উপরে চাপ বেশি পড়ার ফলে ডিভিটি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এখন অনেক মহিলাই কনট্রাসেপ্টিভ পিল ব্যবহার করেন। এই পিলে থাকে ইস্ট্রোজেন হরমোন, যেটা থ্রম্বোজেনিক। ডাক্তারি পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘ দিন ধরে কনট্রাসেপ্টিভ পিল ব্যবহার ডিভিটি-র সম্ভাবনা বহু গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। এ ছাড়া ধূমপান, ক্যানসার (অনেক ক্যানসার ডিভিটি নিয়েই আত্মপ্রকাশ করে) এমনকি হার্টের সমস্যাও হতে পারে এই রোগের কারণ। অনেকের ঘন ঘন পেটের অসুখ হয়। অথচ প্রথাগত ওষুধপত্রে রোগ সারে না। তাঁদের পরীক্ষা করে হয়তো আলসারেটিভ কোলাইটিস বা ক্রোনস ডিজ়িজ় ধরা পড়ল। দুটোই অন্ত্রের রোগ এবং ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজ়িজ় (আইবিডি) গ্রুপের অসুখের অন্তর্ভুক্ত। যাঁদের এমন আইবিডি থাকে, তাঁদেরও প্রবল সম্ভাবনা থাকে ডিভিটি হওয়ার। অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি বা ওবেসিটিও এই রোগের কারণ।
‘‘যাঁদের থ্রম্বোসিস, প্যারালিসিসের মতো রোগের পারিবারিক বা জেনেটিক হিস্ট্রি রয়েছে, তাঁরাও ডিভিটি-তে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে অনেক সময়ে কোনও রোগ জানা না থাকা সত্ত্বেও ডিপ ভেন থ্রম্বোসিস হতে পারে,’’ বলে জানালেন ডা. বিশ্বাস।
ডিভিটি-র সমস্যা
অনেক সময়ে কাফের শিরা থেকে জমা রক্তখণ্ড (থ্রম্বাস) রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে অন্য কোথাও চলে যায়। তখন এই পদ্ধতিকে বলে এম্বলিজ়ম। আর ডাক্তারি ভাষায় জমা রক্তের নামটাও থ্রম্বাস-এর বদলে হয়ে যায় এম্বোলাস। আমরা জানি, হৃদ্যন্ত্র থেকে রক্ত ফুসফুসে যায় পরিশ্রুত হওয়ার জন্য পালমোনারি আর্টারির মাধ্যমে। রক্তপ্রবাহের সঙ্গে জমাট রক্ত অনেক সময়ে এই ধমনীর মধ্যে বা তার শাখাপ্রশাখায় চলে যেতে পারে। একে পালমোনারি এম্বলিজ়ম বলা হয়। যদি ডিপ ভেন থেকে একটু একটু করে ছোট ছোট রক্তখণ্ড (এম্বোলাস) পালমোনারি আর্টারিতে জমা হয়, তখন তাকে ক্রনিক পালমোনারি এম্বলিজ়ম
বলে ধরা হয়।
এ সব ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট ও সময়ের সঙ্গে তা বাড়তে থাকে। কিন্তু রক্তের জমাট বাঁধা খণ্ড যদি হঠাৎ প্রবাহিত হয়ে পালমোনারি আর্টারি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, তা হলে সেই ব্যক্তির আচমকা প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা হতে পারে এবং কাশির সঙ্গে বেরোতে পারে ছিটেফোঁটা রক্ত। এটি হল, অ্যাকিউট পালমোনারি এম্বলিজ়ম (এপিই)। এমনকি এপিই-র কারণে মানুষ কয়েক মিনিটের মধ্যে মারাও যেতে পারেন।
সেই কারণেই পালমোনারি এম্বলিজ়ম রোগটি নিয়ে খুব চিন্তায় থাকেন চিকিৎসকেরা। ডিভিটি সন্দেহ করা হলে অবহেলা করা উচিত নয়, অভিমত ডা. বিশ্বাসের। উপযুক্ত চিকিৎসায় রোগ সেরে গেলেও ভবিষ্যতে আবার রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
রোগ নির্ণয়
ডিপ ভেন থ্রম্বোসিস নির্ণয়ের জন্য পায়ের শিরার (লেগ ভেনস) কালার ডপলার স্টাডি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়াও চিকিৎসকেরা বিভিন্ন রক্ত পরীক্ষা, পেটের ইউএসজি, ইকোকার্ডিয়োগ্রাম ইত্যাদি করে দেখে নেন অন্য কোনও কারণে পায়ের সমস্যাটা হচ্ছে কি না।
চিকিৎসা
ডিভিটি হলে কী করা উচিত আর কী নয় এবং সেই বিষয়ে সচেতন হওয়া সবচেয়ে জরুরি বলে জানালেন ডা. বিশ্বাস। যেমন, যাঁরা ধূমপান করেন, তাঁদের এই অভ্যেস ত্যাগ করতেই হবে। মহিলাদের চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কনট্রাসেপটিভ পিল নেওয়া একেবারেই চলবে না, বিশেষত অনেক দিন ধরে। এখন অনেকেই বাড়িতে বসে কাজ করছেন। কিছু ক্ষণ কাজ করার পরেই একটু হাঁটাচলা করতে হবে। একই নিয়ম বর্তাবে, যাঁরা দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালান তাঁদের ক্ষেত্রেও। সাধারণত, দু’তিন ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া জরুরি ও একটু চলাফেরাও করা দরকার। যাঁরা স্থূলকায়, তাঁদের উদ্যোগ নিতে হবে ওজন কমানোর। অনেকেরই বয়সকালে নানা ধরনের অস্ত্রোপচার হয়। অস্ত্রোপচারের পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলাফেরা শুরু করতে হবে। যাঁরা উঠতে পারবেন না, তাঁদের অন্তত পা, কোমর নাড়াচাড়া করা প্রয়োজন।
ডা. বিশ্বাস বললেন, ‘‘ডায়াটিশিয়ানের পরামর্শ নিয়ে বয়স অনুযায়ী নিয়মমাফিক খাওয়াদাওয়া এবং শারীরিক কসরত ডিভিটি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। তা ছাড়া, ডিভিটি-র রোগীদের শোয়ার সময় পা তুলে শুতে হবে। পা ফোলা থাকলে চলাফেরা করার সময়ে ব্যবহার করতে হবে ইলাস্টিক স্টকিং (বিশেষ ধরনের মোজা)। অ্যান্টি-প্লেটলেট গ্রুপের ওষুধ (অ্যাস্পিরিন বা ক্লপিডগরেল) এই রোগ প্রতিরোধে কাজে লাগে। যদিও যে ব্লাড ক্লটগুলি ইতিমধ্যেই রয়েছে, সেগুলি কিন্তু গলাতে পারে না এই ওষুধ। তার জন্য দরকার হয় অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট।’’ প্রাথমিক ভাবে হেপারিন দিয়ে চিকিৎসার পরে ওরাল অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট শুরু করা হয়। এটি দীর্ঘ দিন চলতে পারে। মাঝেমধ্যে মনিটরিং করে দেখে নিতে হয় ডোজ় ঠিক আছে কি না। ডিভিটির ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন খুব কমই পড়ে। তবে পালমোনারি এম্বলিজ়মের ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন হতে পারে। অনেক সময়ে ডিভিটি রোগীর কুঁচকির শিরার মধ্যে অস্ত্রোপচার করে ছাতার মতো একটি বস্তু লাগিয়ে দেওয়া হয়, যাতে জমাট রক্ত উপরের দিকে উঠতে না পারে। কিন্তু খুব প্রয়োজন ছাড়া এই অস্ত্রোপচার করা হয় না।
ডা. বিশ্বাসের পরামর্শ, ডিভিটি রোগ নির্ণয় এবং তার চিকিৎসার সতর্কতামূলক নিয়মগুলি মেনে চলা খুবই জরুরি। না হলে আবার এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
সৌরজিৎ দাস
মডেল: সুস্মেলী দত্ত, ঐশ্বর্য সেন
ছবি: জয়দীপ দাস
মেকআপ: সুবীর মণ্ডল
লোকেশন: পেঙ্গুইন হোটেল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy