প্রতীকী ছবি।
না। কোভিড-১৯-এর টিকা কালই বাজারে এসে যাবে, এমন নয়। মাসছয়েকের মধ্যে কোভিড-১৯ বধের নতুন কোনও ওষুধও বাজারে আসবে না।
তা হলে এই যে ভারত-সহ গোটা বিশ্বে এই ভয়ঙ্কর ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা প্রতি দিনই বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে, তা রোখার জন্য এখন কী করছেন বিজ্ঞানী ও ভাইরোলজিস্টরা?
কোভিড আক্রান্তের চিকিৎসার মূল অভিমুখটি এখন কী?
বিজ্ঞানী ও ভাইরোলজিস্টদের একাংশ জানাচ্ছেন, এই ধরনের (আরএনএ ভাইরাস) অন্য যে সব ভাইরাসের ওষুধ বাজারে চালু রয়েছে, সেই ওষুধগুলি বা তাদের কম্বিনেশনগুলিকে কোভিড আক্রান্তদের উপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরীক্ষা করে দেখাটাই এখন প্রধান কাজ। তাতে বোঝা যাবে অন্য আরএনএ ভাইরাসকে অকেজো বা নিষ্ক্রিয় করতে তারা যতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পেরেছে, কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রেও তারা ততটা সফল হচ্ছে কি না বা কতটা সফল হচ্ছে।
ইবোলা বা এইচআইভি-র মতো অন্য আরএনএ ভাইরাসের ওষুধ এখন বাজারে এসেছে। রোগ প্রতিরোধে সেগুলির সাফল্যও কম নয়। কিন্তু সেগুলি অতটা কার্যকর বা আদৌ কার্যকর নাও হতে পারে কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে।
সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অমিতাভ নন্দী জানাচ্ছেন, দু’টি আরএনএ ভাইরাসের মধ্যেও অনেক ফারাক থাকে, যেমন তাদের প্রজনন, জিনসজ্জা ও আচার আচরণে। ফলে ইবোলার ওষুধ কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে পুরোপুরি কার্যকর হবেই, এমনটা ভাবা ভুল হবে। তবে ওই ওষুধগুলি কোভিড-১৯ ভাইরাসজনিত শারীরিক ক্ষয়ক্ষতির তারতম্য ঘটাতে পারে কি না, সেটা দেখা খুব প্রয়োজন।
তাঁর মতে, ‘‘মানবসমাজে মানুষ ও জীবাণুর সহবাসের মাধ্যমে একটি বহুমুখী সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এবং যে কোনও একটি মানুষ ভিন্ন ভিন্ন জীবাণুর জন্য শরীরের আলাদা আলাদা প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। তার ফলে, পরে সেই জীবাণুর সংক্রমণের কয়েক দিনের মধ্যেই সেই মানুষটি প্রতিরোধকারী অ্যান্টিবডি তৈরি করে সেই সংক্রমণ নির্মূল করতে পারে। যে কোনও সংক্রমণের মূল উদ্দেশ্য, মানব তথা প্রাণীর শরীরে তার বংশবৃদ্ধি ও পরে বিস্তার ঘটানো। এই প্রক্রিয়ায় দু’টি ঘটনা ঘটে। ১) জীবাণুর বংশবৃদ্ধির ফলে মানবকোষ ধ্বংস এবং ২) তাকে আটকানোর জন্য শারীরিক প্রতিক্রিয়া (প্রদাহ) দেখা যায়। যা কি না অনেক সময় আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। কোভিড-১৯ সংক্রমণের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটে।’’
অমিতাভ বাবুর বক্তব্য, কোভিড ১৯ পৃথিবীতে নতুন। তাই আমরা এখনও এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে, দাবানলের মতো এর সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এর ভিত্তিতেই চিকিৎসার নানা কৌশল নেওয়া হচ্ছে। যার উদ্দেশ্য, কোনও ভাবে যদি ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি ও রোগীর শারীরিক ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা যথাক্রমে দেরি করিয়ে বা কমিয়ে দেওয়া যায়। তাতে শরীর আরও কিছুটা সময় পাবে ভাইরাসকে চিনে নিয়ে নিজেকে তৈরি করে আঘাত হানতে। তাই দু’ধরনের ওষুধের ব্যবহার করা যায় কি না তা নিয়ে পরীক্ষীনিরীক্ষা শুরু হয়েছে। ১) ভাইরাস ধ্বংসকারী ওষুধ। ২) প্রদাহের মাত্রা কমিয়ে আনার ওষুধ। যেহেতু এখন কোভিড-১৯ ধ্বংসকারী ওষুধ বা টিকা আবিষ্কার করে তাকে সকলের কাজে লাগার মতো করে তুলতে আরও সময় লাগবে, তাই এখন অন্য আরএনএ ভাইরাসজনিত রোগের জন্য যে সব ওষুধ ব্যবহৃত হয়, সেগুলি দিয়ে কোভিড-১৯ এর প্রজননকে দমিয়ে রাখা ও প্রদাহ কমিয়ে রাখার জন্য মিলিত চিকিৎসা-প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন: করোনার জেরে মিলছে না শিশুর অন্য রোগের ভ্যাকসিন! কী বিপদ ধাওয়া করছে এর পর?
আরও পড়ুন: মোবাইলেও ঘাপটি মেরে থাকে করোনাভাইরাস, কী ভাবে ব্যবহার করলে দূরে থাকবে অসুখ?
মোহালির ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (আইসার মোহালি)’ ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এখন দরকার হয়ে পড়েছে কিছুটা সময় কেনার। কোভিড-১৯ এর নতুন টিকা বা ওষুধ আবিষ্কার আর তার বাজারে আসার জন্য। আমেরিকায় ইতিমধ্যেই এমন একটি টিকার এখন ‘ফেজ ওয়ান ট্রায়াল’ চলছে। তবে সেটা চালানো হচ্ছে সুস্থ মানুষদের উপর। এই টিকার কোনও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া আছে কি না, থাকলে কী কী, তা বোঝার জন্য। এর পর হবে ‘ফেজ টু’ এবং ‘ফেজ থ্রি ট্রায়াল’। তখনই জানা যাবে কোভিড-১৯ রুখতে এই টিকা কতটা কার্যকর হবে।’’
সেই টিকার প্রকৌশল কী?
ইন্দ্রনীল জানাচ্ছেন, টিকা তৈরি করার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হল, নিষ্ক্রিয় বা জীবন্ত দুর্বল ভাইরাসকে আমাদের শরীরে ঢুকিয়ে দিয়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে তাদের চিনিয়ে দেওয়া। যাতে সেই ভাইরাস পরে আক্রমণ করলে দেহের প্রতিরোধী কোষগুলি তাদের চিনতে পারে এবং তাদের ধ্বংস করে দিতে পারে। কিন্তু টিকা বানানোর এই প্রথাগত পদ্ধতি এই মুহূর্তে কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে করাটা কিছুটা দুরূহই। অন্য উপায়টি হল, সেই ভাইরাসের (এখানে কোভিড -১৯) কয়েকটি ক্ষতিকারক প্রোটিনকে আমাদের শরীরের কোষে ঢুকিয়ে দেওয়া। এই প্রোটিনগুলিকে বলা হয়, ভাইরাল প্রোটিন। এই প্রোটিনগুলি শরীরের কোষে ঢুকে নিজেদের কাজকর্ম শুরু করে দেয় বলেই ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হয়। এই ভাইরাল প্রোটিনগুলিকে তাই শরীরে ঢুকিয়ে শরীরের প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে তাদের চেনাতে হবে। তার পর শরীরের প্রতিরোধী ব্যবস্থা অচেনা শত্রুকে চিনে ফেলে তাকে বধ করা বা রোখার ব্যবস্থা নেবে। এই ভাইরাল প্রোটিনগুলি বানানোর বার্তা বহন করে এক ধরনের আরএনএ। তাদের নাম ‘মেসেঞ্জার আরএনএ’ বা ‘এমআরএনএ’।
ইন্দ্রনীলের কথায়, ‘‘এখন কোভিড-১৯ এর টিকা বানানোর জন্য যে ফেজ ওয়ান ট্রায়াল চলছে, তাতে নিষ্ক্রিয় বা জীবন্ত দুর্বল ভাইরাস বা ভাইরাল প্রোটিন আমাদের শরীরে না ঢুকিয়ে এই মেসেঞ্জার আরএনএ-ই ঢোকানো হচ্ছে। যাতে সেগুলি কোষের মধ্যে প্রবেশ করে। মানব কোষের প্রোটিন বানানোর যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এই মেসেঞ্জার আরএনএ থেকেই ভাইরাল প্রোটিন তৈরি হবে আমাদের কোষে। আর সেই ভাইরাল প্রোটিনকে চিনে নিয়ে তাদের রোখার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবে আমাদের দেহের প্রতিরোধী ব্যবস্থা। যাতে পরে সে কোভিড-১৯-এর মোকাবিলা করতে পারে। কিন্তু এই এমআরএনএ-গুলি আমাদের শরীরে খুবই ক্ষণস্থায়ী হয়। তাই সহজে এরা আমাদের কোষে ঢুকতে পারে না। তাই তাদের কোষে ঢোকানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে লিপিড ন্যানো পার্টিকল। এই ন্যানো পার্টিকলগুলি যেমন ভাইরাসের এমআরএনএ-কে রক্ষা করে তাদের স্থায়িত্ব বাড়ায়, তেমনই সেগুলি কোষের মধ্যে এমআরএনএ-গুলিকে ঢুকিয়ে দিতে সাহায্য় করে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy