Advertisement
E-Paper

কৈশোর কাঁপছে! বিলেতের স্কুলে ‘অ্যাডোলেসেন্স’ দেখানোর ইচ্ছা, অস্বস্তি পৌঁছোল কলকাতায়

গত মাসে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে ৬.৫ কোটি জোড়া চোখ দেখে ফেলেছে ‘অ্যাডোলেসেন্স’ সিরিজ়টি। কৈশোরের সঙ্কট বলা সব দৃশ্য নিয়ে চর্চায় বসল দুই কিশোর-কিশোরী। সঙ্গে অভিভাবকেরাও।

Controversy and concerns addressed by Netflix series adolescence cross boundaries and challenges parents of adolescents in Kolkata too

কী এমন দেখানো হচ্ছে ‘অ্যাডোলেসেন্স’-এর সিরিজ়ে, যা নিয়ে এত তর্ক? ‘অ্যাডোলেসেন্স’ সিরিজ়ের দৃশ্য। সূত্র: এক্স (সাবেক টুইটার)।

সুচন্দ্রা ঘটক

শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:৫৩
Share
Save

আমার মেয়ের ভাগ্যিস ইনস্টাগ্রামে বেশি ঝোঁক নেই! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন মা। তেরো বছরের মেয়ে প্রশ্ন ছুড়ল, ‘‘জানলে কী করে?’’ সঙ্গে জুড়ে দিল, ‘‘পুরো সিরিজ়টা দেখতে দিলে বুঝতাম, যা নিয়ে ভয় পাচ্ছ, সে সব কথা জানি কি না!’’

ইংল্যান্ডে স্কুলে স্কুলে বিনামূল্যে নেটফ্লিক্সের একটি সিরিজ় দেখানোর কথা চলছে। নাম ‘অ্যাডোলেসেন্স’। তা নিয়েই জোর তর্ক। কেউ বলছেন, খুব জরুরি। কারও বক্তব্য বিপজ্জনক। কিশোর-কিশোরীদের এ সব আর না দেখানোই শ্রেয়।

কী এমন দেখানো হচ্ছে সে সিরিজ়ে, যা নিয়ে এত তর্ক?

সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি চর্চিত এখন স্কুলের সহপাঠী এক কিশোরীকে খুনের অভিযোগে জেলে যাওয়া এক কিশোর ও তার পরিবারের এই কাহিনি। পরতে পরতে ‘সাইবারবুলি’ বা নেটমাধ্যমে হেনস্থার উল্লেখ সেখানে। রয়েছে নারীবিদ্বেষী সমকালীন নানা ভাবনার আদানপ্রদানের কথা। কিশোর মনে অ্যান্ড্রু টেটের মতো নারীবিদ্বেষী বিগ্রহের প্রভাব তার মধ্যে অন্যতম।

এক কথায় বলতে গেলে, সে সিরিজ়ে উঠে এসেছে নেট-আসক্ত সময়ে কৈশোরের সঙ্কটের এক অতি কঠিন রূপ। চ্যালেঞ্জে উড়ে গিয়েছে বাবা-মায়েদের কাছে। প্রশ্ন উঠেছে, ঘরের নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বসে থাকা কিশোর সন্তানকে সত্যি নিরাপদেই রাখতে পারছেন কি তাঁরা। উঠে এসেছে আরও বহু বিতর্ক।

তার মধ্যেই ‘অ্যাডোলেসেন্স’ সিরিজ়টি চালিয়ে কলকাতার এক কিশোরী ও তার বাবা-মায়ের সঙ্গে বসা গেল তাঁদের বাড়িতে। সকলে একসঙ্গে বসে সিরিজ়টি দেখা যায় কি? কেনই বা বিতর্ক গড়াল এত দূর? প্রশ্ন ছিল অনেক। উত্তরের খোঁজ চলছিল। কিন্তু গোটা সিরিজ়টি একসঙ্গে দেখতে পারলেন না মা সায়নী। কিশোরী কন্যা অদ্রিজার উৎসাহ একেবারে যে ছিল না, তা নয়। তবে বাবা প্রলয় একটু রেগে যাচ্ছিলেন মনে হল মেয়ের। তাই বন্ধ করার সময়ে কোনও বায়না করে না সে। শুধু নিচু স্বরে বলে, ‘‘পরে দেখে নেওয়া যাবে!’’

ইংল্যান্ডের স্কুলগুলিতে ‘অ্যাডোলেসেন্স’ দেখানো নিয়ে তর্ক ইতিমধ্যে ছড়িয়েছে সে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহু বহু দূর। পৌঁছে গিয়েছে কলকাতাতেও। পৌঁছবে না-ই বা কেন! মার্চের ১৩ তারিখ মুক্তি পাওয়ার পর থেকে ৬.৫ কোটি জোড়া চোখ দেখে ফেলেছে সিরিজ়টি।

বলিউডের চিত্র পরিচালক সুধীর মিশ্র থেকে আমেরিকার টেসলা-কর্তা ইলন মাস্ক— সিরিজ়টি নিয়ে আলোচনায় জড়িয়েছেন দেশ-বিদেশের বহু চর্চিত ব্যক্তি। ভাল-মন্দ, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন সে সব পরে। উপেক্ষা যে করা যাচ্ছে না কম্পনশীল কৈশোরের ক্রোধে জর্জরিত হওয়ার অস্বস্তিকর সব দৃশ্য, সে কথা মানতে বাধ্য হচ্ছেন অভিভাবকেরা।

অদ্রিজার বাবা-মা ‘অ্যাডোলেসেন্স’-এর কথা শুনেছেন তাঁদের বন্ধুদের কাছে। দেখার সাহস হয়নি। কারণ, বাড়ির টিভিতে চালালে মেয়ে দেখবে ভেবে। তবে তা নিয়ে পড়ে ফেলেছেন অঢেল। আনন্দবাজার ডট কমের তরফে যখন একসঙ্গে ‘অ্যাডোলেসেন্স’ দেখার জন্য যোগাযোগ করা হয়, তখন মায়ের সামনে ছিল অদ্রিজা। সে মাকে বলেছে, ‘‘তোমরা না দেখালেও তো আমি দেখে নিতেই পারি।’’ সে সব শুনে অস্বস্তিতে থাকা দুই অভিভাবক রাজি হয়ে যান বসতে। যদিও দ্বিতীয় এপিসোডে গিয়েই আর অস্বস্তি ঢাকতে পারেন না। মাঝেমাঝে দেখেন। আবার কখনও থামিয়ে দেন। তবে কিশোরী কন্যা, অল্প ভয় পেয়ে হলেও, কথা বলে চলে। তাতে হাওয়ার ভার আরও বাড়ে।

ঘরে গমগম করে ছড়িয়ে থাকা অস্বস্তি সামাল দিতে পাশের ফ্ল্যাট থেকে দিদি অনন্যাকে ডেকে আনেন সায়নী। সঙ্গে আসে অদ্রিজার মাসতুতো দাদা ঋক। তার বয়স ১৬। দু’জনেরই ‘অ্যাডোলেসেন্স’ দেখা হয়ে গিয়েছে। তবে ‘ইনসেল’ শব্দের মানে আগে জানা ছিল না বলে দাবি করেছে ঋক।

কিন্তু ঋক বা অদ্রিজার স্কুলে কি চরম নারীবিদ্বেষী চর্চা কখনও হয়নি? ছেলে-মেয়েরা কি বন্ধু হতে পারে বলে মনে করে তারা?

Controversy and concerns addressed by Netflix series adolescence cross boundaries and challenges parents of adolescents in Kolkata too

‘ইনসেল’ মানে ‘অনিচ্ছাকৃত ব্রহ্মচারী’। ‘অ্যাডোলেসেন্স’ বিতর্ক দাঁড়িয়ে আছে ওই শব্দটির উপরে। —ফাইল চিত্র।

যা দেখা যায়, তা সত্য

ইন্টারনেট বলবে ‘ইনসেল’ মানে ‘অনিচ্ছাকৃত ব্রহ্মচারী’। ‘অ্যাডোলেসেন্স’ বিতর্ক দাঁড়িয়ে আছে ওই শব্দটির উপরে। এক কিশোরী এক কিশোরকে এমন কোনও চিহ্ন দেখাল সমাজমাধ্যমে, যা বাকিদের হাসাল। আর কিশোরকে চরম পদক্ষেপের দিকে ঠেলে দিল।

৪৫ পেরোনো সায়নী সরল প্রশ্ন করেন, ‘‘এতটা বিরক্তি কেন হয় ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম দেখে? দেখারই বা দরকার কী?’’ মাসিকে ঋক উত্তর দেয়, তাঁরা না বুঝতে চাইলেও সমাজমাধ্যম আসলেই জীবন। তা সত্য। তা সত্যের থেকে দূরে নয়। স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে আসল বন্ধুত্ব হয় বা শত্রুতা হয় সমাজমাধ্যমেই।

তা যে খুন করার দিকে ঠেলে দিল পর্দার কিশোর জেমিকে, এমন কি বাস্তবে হতে পারে? ঋক এ বার থমকায়। বলে, ‘‘এতটা কি আর হয়! আমিও কি আর এত সব মানে জানতাম? কিন্তু জেমির রাগ হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না।’’

কে কার বন্ধু হয় স্কুলে?

স্কুলে বন্ধু হয়, শত্রুও হয়। ঋক এবং অদ্রিজা এ বিষয়ে একমত। ৪০ ও ৫০ পার করা বাবা-মায়েরা কথা হারান। শত্রুতা আবার স্কুলে হবে কী করে? প্রতিযোগিতা হতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা। কিন্তু তার থেকে খুনে রাগ হয় কী করে? প্রশ্ন অভিভাবকদের। ‘অ্যাডোলেসেন্স’ সিরিজ়টি কী ভাবে এত দূর দেখাল!

Controversy and concerns addressed by Netflix series adolescence cross boundaries and challenges parents of adolescents in Kolkata too

স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে আসল বন্ধুত্ব হয় বা শত্রুতা হয় সমাজমাধ্যমেই। —ফাইল চিত্র।

কোনও ছেলে যদি কোনও মেয়েকে কিছু বলে, তবে তার প্রেমিক বা প্রেমিকার রাগ হয় না? তেমনই কেউ যদি কাউকে মেয়ে হিসাবে ‘অসুন্দর’ বলে অথবা কোনও ছেলেকে ‘ইনসেল’ বলে, তবে তো রাগ হতেই পারে। সরল বাক্যে প্রশ্ন করে ঋক। সায় দেয় অদ্রিজা। আর এ সব কেউ মুখে যত না বলে, আদানপ্রদান সমাজমাধ্যমেই বেশি হয় এবং হওয়া স্বাভাবিক বলে মনে করে দুই কিশোর-কিশোরী।

৫০ পার করা অনন্যা মনে করেন, এ সব কারণেই আর সিরিজ়টি বেশি দখানোর মানে হয় না কোনও স্কুলে। বলেন, ‘‘এ সব দেখলে আরও শিখবে। ঋকও তো আগে এত কিছু জানত না।’’

বাবা-মায়েদের মত স্পষ্ট, ফোন, ল্যাপটপ, সমাজমাধ্যম থেকে দূরে থাকতে হবে। সব কথা অত বলতে হবে না ইন্টারনেটের মাধ্যমে।

আর নিষ্ঠুর ছবিও না দেখলে ভাল। ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে সমাজমাধ্যমে কিছুই না লিখলে বিপদ দূরে থাকে বলে মনে করেন বড়রা।

কোনটা ব্যক্তিগত?

ব্যক্তিগত কোনও ছবি বা কথা সমাজমাধ্যমে কোনও বন্ধুর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ায় বিশ্বাসী নয় অদ্রিজা। যেমনটা করা হয়েছিল ‘অ্যাডোলেসেন্স’-এ। কিন্তু এমন যে হয়েই থাকে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আছে ঋক ও অদ্রিজার।

অদ্রিজা পুরো সিরিজ়টা দেখার সুযোগ না পেলেও বুঝে গিয়েছে বিষয়টি। ঋক জানায়, সিরিজ়টি সচেতন করেছে তাকে। অনেক কিছুই জানা ছিল না এর আগে। নতুন করে ভাবতে হবে, কোনটা ব্যক্তিগত। কারণ, অনেক ছবি, ভিডিয়ো ইতিমধ্যে সমাজমাধ্যমে দিয়ে দিয়েছে সে। এখন অস্বস্তি হচ্ছে ভেবে যে, সে সবও তাকে সমস্যায় ফেলতে পারে।

তবে দেখানো উচিত কিঅ্যাডোলেসেন্স’-এর মতো ছবি?

কিশোর-কিশোরী একমত। দেখানোই দরকার। এ সবই বাস্তবে হওয়া সম্ভব, যা নিয়ে চর্চা শুরু করেছে অ্যাডোলেসেন্স। খানিকটা ভয় করছে তাদের। অস্বস্তি হচ্ছে। তবে জানতেও ইচ্ছা করছে। অদ্রিজা বলে, ‘‘বুঝতে পারছি, ফোন থেকে মাঝেমাঝে দূরে থাকা দরকার।’’

Controversy and concerns addressed by Netflix series adolescence cross boundaries and challenges parents of adolescents in Kolkata too

‘অ্যাডোলেসেন্স’ যা নিয়ে চর্চা শুরু করেছে, সে সবই বাস্তবে হওয়া সম্ভব। ‘অ্যাডোলেসেন্স’ সিরিজ়ের দৃশ্য। সূত্র: এক্স (সাবেক টুইটার)।

তবে একমত হতে পারেননি অভিভাবকেরা। অনন্যা মনে করেন, দেখা দরকার। জানা দরকার। প্রলয়ের মতও খানিকটা তা-ই। তবে সায়নীর অস্বস্তি অঢেল। তিনি বলেন, ‘‘যত দেখবে, তত জানবে। আবার ততই ভুল করার প্রবণতা বাড়বে। কারণ, আরও জানতে ইচ্ছা করবে।’’ আবার সব গুলিয়ে যাবে। ঠিক যেমন যাচ্ছে ছবিটি দেখে।

তবে উপায় কী?

নিষ্ঠুরতা যাতে প্রকাশ পায়, তেমন সিনেমা, সিরিজ দেখা কমাতে বলছেন অভিভাবকেরা। সঙ্গে সমাজমাধ্যম, ভিডিয়ো গেমসের থেকেও দূরত্বের দাবি তাঁদের। কিশোর মন যা দেখে তা-ই জানতে চায়, মনে করেন প্রলয়। তাই আরও বেশি মাঠে যাওয়া, দৌড়ে বেড়ানোয় মন ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে তিনি। কিন্তু সহজ যে নয়, তা তিনিও জানেন। আর বাবার কথা শুনে মেয়ে বলে, ‘‘আমি কয়েকটা নতুন কথা না জানলেই কি সমস্যা মিটবে? সকলে আমাকে বোকা বলবে তো!’’

Adolescence New Web series Netflix Parenting Tips School Students Issue

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}