সাত বছরের সোনু যাদবের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তাকে নিয়ে বাবা–মা যখন বাইপাসের ধারের হাসপাতালে পৌঁছলেন তখন ছেলেটির বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছিল। সামান্য সর্দি-কাশি জ্বর থেকে যে এমনটা হতে পারে তা ভাবতে পারেননি শিক্ষক বাবা মা। হাসপাতালে গিয়ে বুঝলেন দেরি হয়ে গিয়েছে।
রিমিকে স্কুল থেকেই দিয়ে গিয়েছিল বাড়িতে। ধুম জ্বর। বমি হচ্ছে ঘন ঘন। পরের দিন পরীক্ষা। জ্বর কমাতেই হবে। মোড়ের ওষুধের দোকান থেকে এক সঙ্গে চারটি ওষুধ নিয়ে এলেন ইঞ্জিনিয়ার বাবা। মেয়ে পরীক্ষা দিল বটে। তার দিন তিনেক পরেই শয্যাশায়ী ১৪-র রিমি।
রসায়নের স্নাতক স্তরের ছাত্র ইমন হস্টেলে থাকেন। গায়ে হাত পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। ঢোক গিলতে কষ্ট। পাশের ঘরের সিনিয়র দাদার ঘরে মজুত থাকে হরেক কিসিম ওষুধ। সেখান থেকে ওষুধ এল। পাঁচ দিনের মাথায় ইমন হাসপাতালে। চালু হল ভেন্টিলেটর। যমে-মানুষে টানাটানি।
ইমন-রিমি প্রাণে বাঁচলেও সোনুকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি। রিমি অবশ্য পরের পরীক্ষাগুলো দিতে পারেনি। টানা এক মাস স্কুল কামাই। আর ইমন ১২ দিন হাসপাতালে কাটিয়ে ফিরে যান জলপাইগুড়ির বাড়িতে। মাথা তুলে বেশি ক্ষণ বসতে পারেন না রসায়নের মেধাবী ছাত্রটি। কবে ফের ক্লাস করতে পারবেন, জানেন না।
সোনু, রিমি আর ইমন তিন জনের মধ্যে একটাই মিল। ওরা ভুল ওষুধের শিকার। সোনুর বাবাও প্রথমে পাড়ার দোকান থেকে ওষুধ কিনেছিলেন। তার মধ্যে ছিল দু’টি অ্যান্টিবায়োটিক। চিকিৎসকের দাবি, সোনুর মৃত্যুর কারণ ভুল ওষুধ। কয়েক মাস আগে নিউমোনিয়া হয়েছিল ছেলেটির। তখন চিকিৎসায় দেখা যায় একটি অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না ওর শরীরে। নিউমোনিয়ার জীবাণুটি ওই ওষুধে প্রতিরোধ শক্তি অর্জন করেছিল। সামান্য সর্দি জ্বর আর কাশি থেকে ছেলেটিকে চটপট মুক্তি দিতে ওষুধের দোকানি যে অ্যান্টিবায়োটিকটি দেন তা সোনুর দেহ আগেই বাতিল করে দিয়েছে। তাই সেই ওষুধে ফুসফুসের সংক্রমণ তো সারেইনি, প্রতিষেধক না পেয়ে ফুসফুসে জীবাণু লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। দুর্বল শরীরের সাত বছরের ছেলেটি আর লড়তে পারেনি।
রাজ্যে এখন সোনু, রিমি, ইমনদের ছড়াছড়ি। পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, চিকনগুনিয়ার সংক্রমণ তো রয়েছেই। তার সঙ্গে রয়েছে অজানা জীবাণুর আক্রমণ। রোগ নির্ণয় না হওয়ায় রোগটিকে ভাইরাল ফিভার আখ্যা দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। আর ভাইরাল ফিভারের চিকিৎসাতেই অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার চলছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। এক পরজীবী বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, ‘‘বাড়িতে এক জনের হলে সবার জ্বর হচ্ছে। কারণ জীবাণুটি বায়ু বাহিত। বদ্ধ ঘরের মধ্যে নাক ও মুখ দিয়ে একজন থেকে অন্যজনে র মধ্যে সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে রোগটা।’’ এক পরিবার থেকে অনেকে ওই জ্বর নিয়ে এলে রক্ত পরীক্ষার আগেই অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা ধরে নিচ্ছেন এটিও ভাইরাল ফিভার।
এই জ্বর থেকে মুক্তি পেতে হাতের সামনে যে অ্যান্টিবায়োটিক পাচ্ছেন, সেটাই খেয়ে নিচ্ছেন অনেকে। তাতে রোগ তো সারছেই না বরং জটিল হয়ে পড়ছে। রোগীর সাধারণ স্বাস্থ্য যদি খারাপ হয়, তা হলে ইমনের মতো ভেন্টিলেটরে দিতে হচ্ছে। বা সোনুর মতো অকালে প্রাণ যাচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার বদলে দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার হিড়িক কেন?
স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা অমিতাভ নন্দী জানাচ্ছেন, এমনিতেই বাঙালিদের মধ্যে নিজে থেকে চিকিৎসা করার একটা প্রবণতা রয়েছে। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘বাড়িতে বাড়িতে যে জ্বর হচ্ছে তাতে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, চিকনগুনিয়ার সব উপসর্গই থাকছে। প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, ১০৩-৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা, গাঁটে ব্যথা, বমি, পেট খারাপ, নাক দিয়ে জল গড়ানোর সমস্যা থেকে চটজলদি মুক্তি পেতে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগেই অনেকে সহজ পন্থা বের করেছেন। ওষুধের দোকান থেকে পছন্দমতো অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খেয়ে নিচ্ছেন।’’
জীবাণুকে বিনাশ করার জন্যই তো অ্যান্টিবায়োটিক। তা হলে তা শরীরের এমন ক্ষতি করছে কেন?
পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, প্রতিটি অ্যান্টিবায়োটিকের নির্দিষ্ট ডোজ রয়েছে। বয়স, ওজন, শারীরিক অবস্থা, রোগের পূর্ব ইতিহাস— এ সব বিচার করে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক কেন, কোনও ওষুধই দিতে পারে না ওষুধের দোকান। অমিতাভবাবুর মন্তব্য, ‘‘অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত আর ভুল ব্যবহারই ডাকছে সঙ্কট। এক দিকে যেমন বিভিন্ন মানুষের শরীরে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে,
নানা ধরনের ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়াও বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধী হয়ে যাচ্ছে।’’
ক্রিটিক্যাল কেয়ার চিকিৎসক অরিন্দম করের ব্যাখ্যা, ‘‘অ্যান্টিবায়োটিকের এমন যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে যে ডাক্তাররাও বহু সময়ে বুঝে উঠতে পারেন না কাকে কী অ্যান্টিবায়োটিক দেবেন। কারণ প্রথমেই তো কেউ ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেন না। কম ডোজের ওষুধ দেওয়া হল। কিন্তু ডাক্তার জানেন না, রোগীর শরীরে ওই অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে গিয়েছে। ফলে আসল চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয়ে যায়।’’
এক পরজীবী বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ, উন্নত দেশগুলিতে নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক নীতি রয়েছে। কোন কোন অ্যান্টিবায়োটিক কী ভাবে তৈরি হবে, কী ভাবে বিক্রি হবে, কোন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকেরা সেই ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখবেন এবং মানুষ কী ভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করবেন, তা বলা রয়েছে ওই নীতিতে। ধরা যাক কোনও একজন জ্বর, গলাব্যথা নিয়ে ক্লিনিকে গেলেন। চিকিৎসক প্রথমে তাঁর গলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখবেন। কোন ধরনের জীবাণু তা নিশ্চিত হওয়ার পরেই ওষুধ দেবেন। কোন জীবাণুর ক্ষেত্রে কোন ওষুধ, তা নির্দিষ্ট করে বলা আছে। সেই মতো চিকিৎসা হবে। ছোটখাটো সংক্রমণ স্রেফ প্যারাসিটামল এবং অ্যান্টি অ্যালার্জিক ওষুধেই সেরে যায়। তাই উন্নত দেশগুলিতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সীমিত। মানুষও সচেতন। তাই বিপর্যয়ের আশঙ্কাও কম।
কিন্তু এখানে কেন দোকানে গেলেই লোকে নাগাল পেয়ে যাচ্ছেন যে কোনও অ্যান্টিবায়োটিকের? রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোলার চিন্তামণি ঘোষ বলেন, ‘‘এমন ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রির কথাই নয়। কিন্তু আকছার সেটাই হচ্ছে। শুধু দোকানদারদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। মানুষের মধ্যেও সচেতনতা নেই।’’
ড্রাগ কন্ট্রোল কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না? চিন্তামণিবাবুর মতে, নিয়মের ফাঁক গলেই অনিয়ম চলছে। সেটা কেমন? তাঁর যুক্তি, ‘‘প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রির কথা নয়। কিন্তু প্রেসক্রিপশন যে ছিল না, সেটা কী ভাবে প্রমাণ হবে?’’
অর্থাৎ ড্রাগ কন্ট্রোল কিছু করবে না। ভাবতে হবে মানুষকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy