ছাদবাগান তো অনেকেই করেন, কিন্তু তা থেকেই যদি রোজকার বাজার হয়ে যায়! তা হলে কেমন হয় নিজেদের যেটুকু আনাজপাতি লাগে তা ছাদেই ফলানো যায়। তার জন্য জরুরি পরিকল্পনা। বাগান করার আনন্দও মিলবে উপরি হিসেবে। কিন্তু হঠাৎ আনাজপাতির বাগান কেন করবেন
উদ্দেশ্য অর্গ্যানিক ফার্মিং
বাজারে গিয়ে পোকা বেগুন বা নেতিয়ে পড়া কলমি শাকের দিকে কারও হাত যায় না। চকচকে বেগুন বা নিখুঁত শসাটা কিনে হাসিমুখে বাড়ি ফেরা হয়। কিন্তু ওই বেগুন চকচকে করতে কতটা ওয়্যাক্স ব্যবহার করা হয়েছে, পোকা মারতে কতটা কীটনাশক ব্যবহার হয়েছে, সেটা দেখা হয় না। হরিমিট্টি অর্গ্যানিক ফার্মিং সংস্থার কর্ণধার সুহৃদ চন্দ্র বললেন, ‘‘পোকা বেগুন, নেতিয়ে পড়া শাক বিক্রি না হলে ক্ষতি বিক্রেতার। ফলে আনাজ তরতাজা রাখতে ব্যবহার বাড়ছে রাসায়নিক ও কীটনাশকের। আর রোজ খাবারের মাধ্যমে সেই কীটনাশক জমছে শরীরে। দীর্ঘকালীন এই খাদ্যাভ্যাস জটিল রোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই জন্যই রাসায়নিক ও কীটনাশক ছাড়া জৈব পন্থায় আনাজ ফলানোর প্রচেষ্টা। ছাদে রোজকার খাবারের মতো আনাজের বাগান করা সম্ভব।’’
জমি তৈরিতে ভার্মিকম্পোস্ট
প্রথমে চাষের জমি প্রস্তুত করতে হবে। আইআইটি খড়্গপুরের কৃষি ও খাদ্য বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক বিজয় চন্দ্র ঘোষ বললেন, ‘‘জমি তৈরি করতে লাগবে ভার্মিকম্পোস্ট। এই ভার্মিকম্পোস্ট নিজে তৈরি করি। এসেনিয়া ফোটিডা, ইউড্রিলাস, পেরিয়োনিক্স এই তিন প্রজাতির কেঁচো ব্যবহার করে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি করা হয়। এই ধরনের কেঁচো জৈব বর্জ্য খায়। তার পরে এরা যে বিষ্ঠা ত্যাগ করে তা হরমোন, এনজ়াইম ও অন্যান্য পুষ্টিগুণে ভরপুর। ফলে তা যদি মাটিতে দেওয়া হয়, মাটির উর্বরতা অনেক বেড়ে যায়। এই বর্জ্যের সঙ্গে একটু গোবর মিশিয়ে দিলে আরও ভাল হয়। জমি তৈরি করতে ৪০ শতাংশ ভার্মিকম্পোস্ট, ৩০ শতাংশ মাটি ও বাকি ৩০ শতাংশে নির্দিষ্ট অনুপাতে দেওয়া হয় কোকোপিট, নিমের খোল, হাড়ের গুঁড়ো ও নানা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস। এই সব কিছু মিশিয়ে যে মাটি তৈরি হয়, তা সাধারণ মাটির চেয়ে অনেক উর্বর।’’
কী ভাবে হবে এই চাষ
ছাদে ৪০-৫০ থেকে ৫০০ বর্গফুট জায়গাতেও চাষ করতে পারেন। ক্রেটে আনাজের গাছ লাগিয়ে বা দু’টি বেড তৈরি করে তার উপরে চাষ করা যায়। ছাদের উপরে একটা স্তর তৈরি করে তার উপরে চাষ হয়। ছাদে জলও লিক করবে না এবং ভারও সীমিত রাখা হয় বলে আশ্বাস দিলেন অধ্যাপক বিজয় চন্দ্র ঘোষ।
মরসুমি ফসলের চাষ করতে পারেন। এতে ফলন ভাল হয়। শীতে ফুলকপি বা পালং শাক করতে পারেন। আবার গরম এলে গাছ বদলে লাউ, কুমড়ো, উচ্ছে, পটল লাগানো যায়। তবে চাইলে চেরি টম্যাটো, ব্রকোলি, পাকচয়, ক্যাপসিকামের মতো আনাজও চাষ করা যায় বলে জানালেন অধ্যাপক বিজয় চন্দ্র ঘোষ।
এই কৃষি পদ্ধতিতে কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। পোকামাকড় মারতে কীটনাশকে যে বিষ ব্যবহার করা হয়, তার কিছুটা অংশ খাবারের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। সুহৃদের কথায়, ‘‘লেটুস, ধনেপাতা স্যালাডে কাঁচা খাওয়া হয়। তার মাধ্যমে রাসায়নিক ও কীটনাশক শরীরে প্রবেশ করার সম্ভাবনা বেশি। তাই এই শাকপাতা বাজার থেকে না কিনে বাড়িতেই ফলাতে পারেন। আর কীটনাশক ব্যবহার করে পোকা না মেরে বরং পোকামাকড় যাতে গাছে না আসে, তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পোকামাকড় তাড়ানোর জন্য নিমতেল ব্যবহার করা হয়। সাধারণত গাছের পাতার রস খেতেই পোকাদের আনাগোনা বাড়ে। কিন্তু তা যখন বিস্বাদ হয়ে যায়, তখন ধীরে ধীরে পোকামাকড় চলে যায়।’’
জায়গা কম থাকলে ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং করা যায়। একটা ক্রেটের মধ্যে নীচে বেগুন গাছ করলে পাশে উচ্ছের মতো লতানে গাছ করা যায়। পালং, কলমি জাতীয় শাক দিয়েই অর্গ্যানিক চাষ শুরু করলে ভাল। এতে গাছও তাড়াতাড়ি বাড়ে, ফলে উৎসাহ তৈরি হয়।
ফলের গাছ করতে চাইলে ক্রেটে হবে না। কারণ আম, সবেদা ইত্যাদি ফলের গাছের শিকড় গভীরে ছড়িয়ে যায়। তা ছাড়া ফলের গাছ তো একটা মরসুমের জন্য লাগানো হয় না। এগুলো সম্পদ। একবার লাগালে সেটা থেকে যায়। তাই বড় ড্রামে ফলের গাছ করতে পারেন। এতে ওরা বাড়বে ভাল। টিকবেও অনেক দিন।
উপকার বহুমুখী
অধ্যাপক বিজয় চন্দ্র ঘোষ বলছেন, ‘‘রোজ কীটনাশকমুক্ত আনাজপাতি খেতে পারবেন, সেই প্রাপ্তি তো রয়েছেই। এর পরে রয়েছে অগাধ অক্সিজেনের জোগান। ছাদে বাগান থাকলে ছাদের হিট নীচে নামবে না। ফলে কৃত্রিম এয়ারকন্ডিশনিংয়ের প্রয়োজন পড়বে না। ছাদের নীচের ঘর ঠান্ডা থাকবে। নগরজীবন থেকে যেসব পাখি, প্রজাপতি হারিয়ে গিয়েছে, তা-ও ফিরে আসবে বাগানে। আর বাড়ির ছাদে সবুজ খেতের মতো মন ভাল করা সঙ্গী দুটো হয় না।’’ বয়স্করাও সবুজ সঙ্গী পাবেন। রোজ বাজার যাওয়ার ঝক্কি পোহাতে হবে না। বাড়ির খুদেটিকে গাছের দেখভালের দায়িত্ব দিলে ভার্চুয়াল জগৎ থেকে বেরিয়ে সে-ও প্রকৃতির স্পর্শ পাবে। ছাদে চাষের পদ্ধতি শিখতে সুভাষ মুখার্জি মেমোরিয়াল ল্যাবে (বেহালা ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্টেট) ট্রেনিং নিতে পারেন। আবার সরাসরি অর্গ্যানিক ফার্মিং সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারাই ছাদটাকে আবাদযোগ্য করে তুলবে।
ছাদ না থাকলে
যাদের বাড়ি নেই, ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের জন্যও দু’টি উপায় আছে। এক, নিজের আবাসনের সকলকে নিয়ে পরিকল্পনা করে আবাসনের ছাদ ব্যবহার করতে পারেন। কারণ একটা আবাসনে যত জন থাকেন, সেই পরিবার পিছু ৫০ বর্গফুট জায়গা বেরিয়েই যায়। নতুন মডেলের অনেক ফ্ল্যাটেই ছাদে গ্রিন জ়োন রাখা হচ্ছে। ফ্ল্যাটের ব্যালকনি চওড়া হলে বা লাগোয়া ছাদ থাকলে সেখানে ৪-৫ রকম আনাজপাতি করতে পারেন। অন্তত মাইক্রোগ্রিন ও শাকপাতি বাড়িতে করে ফেলা যায়।
দ্বিতীয় উপায়টি হল বাইরের জমিতে চাষ। প্লট করে জমি সাবস্ক্রাইব করতে পারেন অর্গ্যানিক ফার্মিং সংস্থার মাধ্যমে। ধরুন আপনি ৬০০ বর্গফুট জমি সাবস্ক্রাইব করলেন নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে। সেখান থেকে সম্পূর্ণ জৈব উপায়ে তৈরি আনাজ পেয়ে যাবেন। আপনি নিজে গিয়েও আনাজপাতি তুলে আনতে পারেন। ছোটদের দিয়ে গাছ লাগিয়ে, বাগানের পরিচর্যা করে সময় কাটিয়েও আসতে পারেন।
এতে সবুজের স্পর্শ নিয়ে মাটির কাছাকাছি বাঁচতে শিখবে আপনার সন্তান। অন্তত নিজের খাবারটুকু সে ফলিয়ে নিতে পারবে। তার সঙ্গে এই স্বস্তিটুকুও থাকবে যে, তার খাবারে কীটনাশক ও রাসায়নিকের মতো গরল মিশছে না। আগামী সুস্থ জীবনের জন্য এটুকু সূচনা করাই যায়।
ছবি: হরিমিট্টি অর্গ্যানিক
ফার্মিং সংস্থা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy