মনের কোথাও কি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে শব্দের বদল? ফাইল ছবি।
সেন্ট্রাল বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশন (সিবিএসই)-এর তরফে দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে আজ। ফল প্রকাশের পরই নতুন চমক। এ বার থেকে ‘ফেল’ শব্দটি উঠে যাচ্ছে সিবিএসই মার্কশিট থেকে। বরং অন্য একটি প্রতিশব্দ লেখা হয়েছে এবার। লেখা হয়েছে ‘এসেনশিয়াল রিপিট’। শুধুমাত্র একটি পরীক্ষায় ব্যর্থতার কারণে পড়ুয়াদের হতাশাগ্রস্ত হওয়া এমনকি আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার ঘটনা প্রায়শই চোখে পড়ে। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বোর্ডের এই সিদ্ধান্তে কতটা প্রভাব পড়বে পড়ুয়াদের উপর?
একে পড়ার চাপ। তার পর পরীক্ষা। পরীক্ষার পর ফল প্রকাশ এবং প্রত্যাশার ভারে জর্জরিত পড়ুয়ারা। এ কথা মাথায় রেখেই ‘ফেলড’, ‘কমপার্টমেন্টাল’ শব্দগুলি মার্কশিট থেকে সরিয়ে নিতে উদ্যোগী হয়েছে সিবিএসই। এর আগে স্কুলের প্রিন্সিপাল এবং আঞ্চলিক দপ্তরের কাছেও মার্কশিটে এই বদল আনার বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছিল বোর্ড। পড়ুয়াদের মনে যাতে আঘাত না লাগে, তাই বোর্ডের তরফে কমপার্টমেন্টালের বদলে ‘স্পেশাল পরীক্ষা’, ‘দ্বিতীয়’ বা ‘সেকেন্ড পরীক্ষা’ বা ‘সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা’ লেখার কথা বলা হয়েছিল একটি প্রস্তাবে। ফেলের বদলে ‘আনকোয়ালিফায়েড’ বা ‘নট কোয়ালিফায়েড’ এই শব্দদুটির প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল।
একটা পরীক্ষাই তো জীবনের শেষ কথা নয়। এ কথা তো সবারই জানা। তবু ব্যর্থতার মনস্তত্ত্বে কোথাও কি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এই শব্দের বদল? এই সিদ্ধান্ত কতটা প্রভাব ফেলতে পারে পড়ুয়াদের মনে? কী বলছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা?
আরও খবর: সিবিএসই-র দ্বাদশ শ্রেণির ফল প্রকাশিত, পাওয়া যাবে অনলাইনেই
মনোরোগ চিকিৎসক অমিতাভ মুখোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে বলেন, "এটি অবশ্যই ইতিবাচক একটা পদক্ষেপ। কারণ সমাজ, বাবা-মা কিংবা বাচ্চারা ‘ফেল’ বা ‘ফেলিওর’ শব্দগুলিকে কেউই ভাল ভাবে মেনে নিতে পারে না এখনও। কিছু শব্দকে মানুষ গ্রহণ করতে পারে না এখনও। সমস্যা হয়, এমনকি আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে। ঠিক যেমন মানসিক সমস্যা থাকলে, ‘স্কিৎজোফ্রেনিক’ হলে যেমন চিকিৎসকদের অনেকেই ‘ডোপামিন ডিসরেগুলেশন’-এর মতো শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন, কারণ সে ক্ষেত্রে রোগীর কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকে। ‘স্টিগমা’ থাকে না। তাই খানিকটা হলেও এ পদক্ষেপ অবশ্যই ইতিবাচক।''
পরীক্ষায় পাশ করতে না পারেনি, মার্কশিটে এ কথা দেখার পরই ট্রমার শিকারও হয় অনেক পড়ুয়া। আত্মহত্যার পথ বেছে না নিলেও পরবর্তীতে কোনও ইতিবাচক কাজের ইচ্ছাটাও মরে যায়। মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় বোর্ডের এই সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে বলেন, ''ফেল শব্দের বদলে 'এসেনশিয়াল রিপিট' শব্দটি তুলনায় কম ভারসম্পন্ন। যদিও কেন্দ্রীয় বোর্ডের পড়ুয়া অবশ্যই 'রিপিট' শব্দের অর্থ জানেন। কিন্তু 'এসেনশিয়াল রিপিট' বলায় ব্যর্থতাকে আলাদা করে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। ব্যর্থ বলতে একটা চরম অবস্থার কথাই মনে হয়। সে ক্ষেত্রে এটি অবশ্যই ইতিবাচক পদক্ষেপ। 'রিপিট' শব্দের মধ্যে কোথাও নতুন করে পরীক্ষা দেওয়া বা বাধা অতিক্রম করার ইঙ্গিত রয়েছে। যদিও ডাক্তারি কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়া পড়ুয়ারা রিপিটর শব্দের সঙ্গে পরিচিত।’’
আরও খবর: লকডাউনে ছোটদের কাছে পাচ্ছেন বেশি, ভাল অভ্যাস গড়ে তুলবেন কী ভাবে?
রিপিটর অর্থাৎ নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করা— এভাবে যদি দেখা যায়, তাহলে তা প্রয়োগ করে দেখা যেতেই পারে। আদৌ তা আখেরে কতটা লাভজনক হয় পড়ুয়াদের জন্য সেটি পরবর্তীতে বোঝা যাবে। নিজেদের মূল্যায়নকে এর ফলে আশাব্যঞ্জকভাবে দেখতে পারেন পড়ুয়ারা, কোনও চরম মূল্যায়ন হিসেবে নয়, এমনটাই মনে করেন অনুত্তমা।
যদিও মনোরোগ চিকিৎসক দেবাশিস রায়ের মত এই প্রসঙ্গে খানিকটা ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘‘এটা শুধু শব্দ প্রয়োগে বদল। কারণ ফেল শব্দটা বহু ব্যবহত। তাই এর আলাদা একটা সংজ্ঞা তৈরি হয়েছে। নতুন শব্দ দুটি বহু ব্যবহৃত হলেও তার সংজ্ঞাটাও ফেল-এর মতোই হবে। বরং শিক্ষার প্যারামিটার বা বৈশিষ্ট্য, মান নির্ধারণ, কীভাবে পড়ুয়াদের পড়ানো হচ্ছে, সেই বিষয়ে নজর দিতে হবে। ফেল তুলে দিয়ে এসেনশিয়াল রিপিট আসলে উপরিতলে বদল অর্থাৎ সুপারফিশিয়াল চেঞ্জ ।’’
নিজেদের মূল্যায়নকে আশাব্যঞ্জক ভাবে দেখতে পারেন পড়ুয়ারা। ফাইল ছবি।
লং টার্ম অর্থাৎ দীর্ঘকালীন সময় ধরলে এই বদলের কোনও প্রভাব পড়ুয়া মনস্তত্ত্বে পড়বে না এমনই মত দেবাশিসবাবুর। পাশ-ফেল প্রথা তুলে দেওয়া বা ব্যর্থতাকে অন্য শব্দের সঙ্গে প্রতিস্থাপনের পরিবর্তে শিক্ষাদানের পদ্ধতি, শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রমের দিকে নজর দেওয়াকেই জরুরি বলে মনে করছেন তিনি।
চিকিৎসা মনোবিদ প্রশান্ত কুমার রায় যদিও এই পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসাবেই দেখার পক্ষপাতী। তাঁর কথায়, ‘‘ফেল নির্ধারণের মাপকাঠি তো আমরাই ঠিক করেছি। ৪০ শতাংশ, ৫০ শতাংশ ইত্যাদি। একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে যে দক্ষতা অর্জনের কথা, তাতে কেউ ব্যর্থ হল, ধরে নেওয়া হয় এমনটাই। সত্যিই কি তাই? কারণ এক শ্রেণি থেকে অন্য শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য যতগুলো বিষয়ে দক্ষতা প্রয়োজন হয়। তাতে হয়তো কেউ প্রতিটি বিষয়ে দক্ষ হয়নি। কিন্তু কিছু শেখেনি, এমন হতেই পারে না।’’
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কথায়, কাউকে ব্যর্থ বা 'ফেলিওর' সরাসরি বলে দেওয়ার মানে সে কিছু শিখতে পারেনি। কিন্তু সেখানে যদি বলা হয়, সে যতগুলি দক্ষতা অর্জন করেছে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার চেয়ে হয়তো বেশি সময় প্রয়োজন, সেটা ইতিবাচক তো বটেই। ৬ মাস কিংবা এক বছরে সেই দক্ষতা রপ্ত করতে সে চেষ্টা করবে, এভাবে ভাবা যেতেই পারে এই শব্দ বদলের বিষয়টিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy