সচেতনতার মাধ্যমেই রুখতে হবে স্তন ক্যানসার। ছবি: আইস্টক।
কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণের থেকে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে মেয়েদের এই মারণ অসুখ। তাই এই অতিমারির সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অক্টোবর মাস জুড়ে পালন করা হচ্ছে স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাস।
আমাদের দেশে প্রতি ২ জন স্তন ক্যানসারে আক্রান্তের মধ্যে ১ জন মারা যান। এর অন্যতম কারণ অসুখটা যখন ডালপালা বিস্তার করে শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বেশিরভাগ মেয়ের তখনই হুঁশ হয়। সংকোচ কাটিয়ে ছুটে যান ডাক্তারের কাছে। কিন্তু ডাক্তারবাবুরা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সব কটা হাতিয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েও শেষ রক্ষা করতে পারেন না, জানালেন চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা ক্যানসার সার্জন জয়ন্ত চক্রবর্তী।
এ দেশের বেশিরভাগ মা বোনেরা সংকোচবশত স্তন সংক্রান্ত সমস্যা হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে দ্বিধা করে। আর এই কারণেই ভারতের ৫০% এর বেশি মহিলা পর্যায় ৩ ও পর্যায় ৪ স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত।
জয়ন্ত চক্রবর্তী জানান, প্রাথমিক অবস্থায় রোগ ধরা পড়লে ও সঠিক চিকিৎসা করলে মৃত্যুহার অনেকাংশে কমিয়ে দেওয়া যায়। সেই কারনেই স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাসে জোর দেওয়া হয়েছে দ্রুত রোগ নির্ণয়ের ওপর। করোনা অতিমারির বছরেও আমাদের দেশে প্রতি ৪ মিনিটে ১ জন মহিলার স্তন ক্যানসার শনাক্ত হচ্ছে, প্রতি ১৩ মিনিটে এই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ১ জন মারা যাচ্ছেন।
আরও পড়ুন: কোভিড পরিস্থিতিতে বেড়েছে ঘাটতি, রক্তদান নিয়ে এই গুলি খেয়াল রাখতেই হবে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের হিসেবে প্রতি বছর প্রায় ১৪ লক্ষ (১.৩৮ মিলিয়ন) মহিলা নতুন করে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং ৪,৫৮,০০০ জন মারা যাচ্ছেন। কিন্তু তাও মেয়েদের মধ্যে এই ব্যাপারে সেভাবে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি জানালেন জয়ন্তবাবু।
পৃথিবীজুড়ে স্তন ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের উদ্যোগে প্রতি বছর ১-৩১ অক্টোবর স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাস পালন করা হয়। এ বারে কোভিড অতিমারির সময়ে স্তন ক্যানসার নিয়ে সচেতন করার জন্যে পদযাত্রা বা সম্মেলন করা না গেলেও সিএনসিআই-সহ দেশের অন্য ক্যানসার হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আসা রোগীদের ‘সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন’-এর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। জয়ন্ত বাবুর পরামর্শ শুধু অক্টোবর মাসেই নয় সচেতন থাকতে হবে বছরভর। মানুষের সভ্যতার শুরু থেকেই স্তন ক্যানসার আমাদের সঙ্গী। প্রাচীন মিশরের ইতিহাসেও এই রোগের উল্লেখ পাওয়া গেছে। এডুইন স্মিথের মালিকানায় থাকা প্যাপিরাসে মোট সর্বমোট আট জন মহিলার স্তনে বিশেষ ধরনের অর্বুদের উল্লেখ পাওয়া গেছে, যা অল্প বয়সি মেয়েদের মৃত্যুর কারণ। আসলে সেই অর্বুদই ছিল মারণ ক্যানসার। সে কালে রোগ নির্ণয় আর চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেছিলেন যে স্তনের আঘাত আর সন্তানকে স্তন্যপান না করানো স্তনের অর্বুদের মূল কারণ।
আরও পড়ুন: করোনা আবহে নখ নিয়ে এই বিষয়গুলি মানতেই হবে
এখনকার চিকিৎসা বিজ্ঞানীরাও এই বিষয়ে একমত। স্তন ক্যানসার এমনই এক অসুখ যা প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরোপুরি সারিয়ে তোলা যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ধরা পড়লে ৬০% ও তৃতীয় পর্যায়ে ৩০% রোগীকে সুস্থ করে তোলা যায়। তাই জয়ন্ত চক্রবর্তী সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশনের উপর জোর দিতে অনুরোধ করছেন বার বার।
প্রতি মাসের নির্দিষ্ট দিনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতের তালু দিয়ে স্তন পরীক্ষা করা দরকার। কোনও অস্বাভাবিক ব্যথাহীন ফোলা অংশ হাতে ঠেকলে কোনও দ্বিধা না করে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ স্তন ক্যানসার দ্রুত নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা করালে রোগীর জীবনের মেয়াদ বাড়ানো যায়। ব্যথা না হলে বেশিরভাগ মানুষই সমস্যাকে গুরুত্ব দেন না, জানান জয়ন্তবাবু। স্তনে কোনও ডেলার মতো অংশ হলেই যে ক্যানসারের আশঙ্কা করতে হবে তা কিন্তু নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলি সাধারণ টিউমার। তবে রোগ নির্ণয়ের জন্যে অবশ্যই ডাক্তার দেখানো উচিত, পরামর্শ জয়ন্ত বাবুর। এই অসুখকে নির্মূল করার একমাত্র উপায় অস্ত্রোপচার করা। অস্ত্রোপচারের কথা শুনে পিছিয়ে গেলে রোগ ছড়িয়ে পড়ে। স্তন ক্যানসারের অ্যাডভান্সড পর্যায়ে এলএলবিবি অর্থাৎ ফুসফুস, লিভার, মস্তিষ্ক, হাড় এই সব অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: কোভিডের উপসর্গে জ্বরের দোসর হাত-পা ব্যথা? কী খেয়াল রাখতেই হবে?
স্তন ক্যানসারের প্রাথমিক অবস্থায় কোনও ব্যথা বেদনা থাকে না। ক্যানসার ছড়িয়ে পড়লে ব্যথা শুরু হয়। ৩ বছর আগে ক্যানসার সচেতনতার এই মাসে শপথ নেওয়া হয়েছিল ২০৫০ সালে একজনও স্তন ক্যানসার রোগীকে মরতে দেওয়া চলবে না। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সচেতনতার যথেষ্ট অভাব আছে। তাই আজও আমাদের দেশের স্তন ক্যানসার আক্রান্তদের ৫০% মারা যান। স্তন ক্যানসারের সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে এখনও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বিশ বাঁও জলে।
প্রতি মাসের নির্দিষ্ট দিনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতের তালু দিয়ে স্তন পরীক্ষা করা দরকার। ফাইল ছবি।
বিজ্ঞানীরা জেনেছেন যে বিএআরসি-১ ও বিএআরসি -২ নামে দুটি জিন স্তন ও ডিম্বাশয় ক্যানসারের জন্যে দায়ী। বংশগত কারণ ক্যানসারের জন্যে কিছুটা দায়ী। বাড়তি ওজন, শুয়ে বসে অলস জীবন যাপন, ধূমপান, মদ্যপান, অতিরিক্ত ভাজাভুজি ও ফাস্ট ফুড খাওয়া, বেশি বয়সে বিয়ে বা সন্তান না হওয়া, সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানো, রোজকার ডায়েটে প্রয়োজনীয় আয়োডিনের অভাব, অল্প বয়সে ঋতু শুরু ও বেশি বয়সে ঋতুনিবৃত্তির সঙ্গে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্পর্ক আছে।
আরও পড়ুন: নিউ নর্মালে সম্পর্ক ভাল রাখতে কী করবেন, কী করবেন না
আবার ঋতুনিবৃত্তির পর হরমোন থেরাপি করালে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। নিয়মিত শরীরচর্চা ও সঠিক ডায়েট এই রোগ প্রতিরোধ করতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের দাবি। ক্যানসার নির্ণয় হওয়ার পর কার কী ধরনের চিকিৎসা প্রয়োজন তা রোগীকে খুঁটিয়ে দেখে ঠিক করা হয়। ক্যানসার আক্রান্ত টিউমার বেড়ে গেলে কেমোথেরাপির সাহায্যে টিউমার ছোট করে নিয়ে সার্জারি করে রোগ আটকে দেওয়া হয় বলে আশ্বাস দিলেন জয়ন্তবাবু। লজ্জা সংকোচ না করে কর্কট রোগের বিরুদ্ধে সচেতন হয়ে হবে সবাইকে। ক্যানসারের বিরুদ্ধে সবথেকে বড় হাতিয়ার সচেতনতা। ভাল থাকুন, ক্যানসার মুক্ত থাকুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy