রোগী দেখছেন চিকিৎসক। ছবি: বিকাশ মশান
প্রশ্ন: বয়স বাড়লেই নানা শারীরিক সমস্যা শুরু হবে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বেশ কম বয়স থেকেই নানা শারীরিক সমস্যা দেখা যাচ্ছে আজকাল। এটা কেন হচ্ছে?
উত্তর: শরীরের সমস্যা নানা কারণে হতে পারে। তবে সবার আগে খাদ্যাভ্যাসের দিকে নজর দিতে হবে। আরও সহজ কথায় বললে খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা চাই। পরিমিত আহার করতে হবে। বেশি খেলেই কিন্তু সমস্যা। কম বয়স থেকেই খাদ্যাভ্যাসে সংযম আনতে হবে। এর মধ্যেই আগামী দিনের সুস্থতার বীজ লুকিয়ে আছে। শুরুটা কিন্তু শৈশবেই করা যায়।
প্রশ্ন: ছোটবেলায় ছেলে-মেয়েদের বেশি করে খাওয়ান বাবা-মায়েরা। কারণ, তখন তারা বেড়ে উঠছে। পুষ্টির প্রয়োজন। তা হলে কোন বয়স থেকে খাদ্যাভ্যাসে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে?
উত্তর: খাওয়া কমানোর বিষয় নয়, ছোট থেকেই নিয়ম মেনে খেতে হবে। মা-বাবা খাওয়াতে ভালবাসেন। ছেলে-মেয়েও খেতে ভালবাসে। যেখানে যাচ্ছে সেখানেই ফাস্টফুড খেয়ে নিচ্ছে। কোন খাবারে কত ক্যালোরি সেটা ভাবা তো দূরের কথা, কতটা ক্যালোরি শরীরে ঢুকছে তা নিয়ে কোনও চিন্তাভাবনা নেই। কোনও কিছুই বেশি খাওয়া উচিত নয়। এগুলিই বয়স বাড়লে শরীরে নানা সমস্যা তৈরি করে।
প্রশ্ন: বেশি ফাস্টফুড খেলে কী হবে?
উত্তর: বেশি পরিমাণে ফাস্টফুড খেলে সবার আগে লিভার নষ্ট হবে। লিভারে ফ্যাট জমবে। অনেকে বলেন ফ্যাটি লিভার কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু তা ঠিক নয়। এর থেকে ক্যানসারের আশঙ্কাও থেকে যায়।
প্রশ্ন: খাওয়া যে বেশি হচ্ছে বাইরে থেকে দেখে কী ভাবে বোঝা যাবে?
উত্তর: এটা বোঝা সহজ। এ ক্ষেত্রে শরীরের ওজন দ্রুত বাড়তে থাকবে। মানে দ্রুত মোটা হওয়া। এ দেশকে এখন বলা হচ্ছে ডায়াবিটিসের রাজধানী। আসলে নিয়ম মেনে না খেয়ে বেশি খেলেই পুরো সিস্টেমটা গোলমেলে হয়ে যায়। সেটা সব সময় মাথায় রাখা দরকার। আর বেশি বয়সে এর ফল ভুগতে হয়।
প্রশ্ন: আধুনিক জীবনযাপন প্রণালী কোনও সমস্যা ডেকে আনছে কি?
উত্তর: নিশ্চয়ই আনছে। আগে কত কাজ পায়ে হেঁটে সারতে হত! সারা দিনে কাজের প্রয়োজনেই কত হাঁটাচলা হত। এখন আর সে দিন নেই। যাঁরা চাষবাস করেন, তাঁরা না হয় মাঠেঘাটে কাজ করছেন। কিন্তু আমাদের অধিকাংশকেই চেয়ারে বসে বা ল্যাপটপে কাজ করতে হয়। ফলে শিরদাঁড়ায় সমস্যা দেখা দিচ্ছে। স্পন্ডিলোসিস হচ্ছে। বিশেষ করে মেয়েরা ভুগছে। তাই নিয়মিত হাঁটা এবং কিছু যোগব্যায়াম করা দরকার। তা হলে শরীরের সহনশীলতা বাড়বে। সমস্যা কমবে। মনে রাখা দরকার বেশি বয়সে শরীরকে সচল রাখতে গেলে প্রথম থেকেই হাঁটাচলা ও ব্যায়ামের দিকে নজর দিতে হবে। আজকের পরিশ্রম আগামী দিনে সুস্থতার ভিত গড়ে দেবে।
প্রশ্ন: অনেকেই আছেন, ৫০ বছর পর্যন্ত সুস্থ রয়েছেন। কোনও রোগবালাই নেই। কিন্তু বয়স হচ্ছে বলে ভাবতে শুরু করেছেন। আগামী দিনে তাঁরা কী ভাবে শরীরকে ঠিক রাখবেন?
উত্তর: কিছুই না। পরিমিত আহার করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। কিন্তু অতিরিক্ত ব্যায়াম করলে হবে না। তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। সব থেকে ভাল যদি এক জন প্রশিক্ষক রেখে তাঁর তত্ত্বাবধানে ব্যায়াম করা যায়। তিনি বলে দেবেন, কোন ব্যায়াম কতক্ষণ বা কত বার করে করা দরকার। আমাদের অন্যতম সমস্যা, ব্যালান্সড ডায়েট সম্বন্ধে অধিকাংশের কোনও সম্যক ধারণা নেই। যত রকমের ফাস্ট ফুড আছে সবগুলিতেই শর্করা বেশি থাকে। তাই সবার আগে শর্করা বেশি আছে এমন খাবার বর্জন করতে হবে। জানতে হবে, ভাত খেলে সুগার বাড়তে পারে, আবার রুটি খেলেও। কিন্তু ভাতে যত ক্যালোরি, রুটিতে তার থেকে কম। আবার শশা খেলে আরও কম। তাই কী খেতে হবে তা ডায়েটিসিয়ানের সঙ্গে পরামর্শ করে খেলে ভাল হয়।
প্রশ্ন: এখন বাচ্চাদের বেবিফুড খাওয়ানোর প্রবণতা আগের থেকে বেড়েছে। এর কোনও কুপ্রভাব আছে কি?
উত্তর: আসলে মায়েদের অনেকেরই প্রকৃত শিক্ষার অভাব রয়েছে। তাই বেশি করে বেবিফুড খাওয়ান তাঁরা। মায়ের দুধ খাওয়ানো কমছে। এ সব আগে তো তেমন শোনা যেত না। আমাদের প্রাকৃতিক নিয়ম মানতে হবে। বাচ্চাকে ছ’মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানোর পরে হয়তো গরুর দুধ বা অন্য কিছু জল মিশিয়ে সইয়ে সইয়ে খাওয়ানোর অভ্যাস গড়তে হবে।
প্রশ্ন: অনেক মা ছেলে-মেয়েরা দ্রুত বাড়বে বলে বেশি করে ভাত খাওয়ান। সেটা কি ঠিক?
উত্তর: আমরা এখনও তেমন অবস্থায় পৌঁছইনি, যে এক বার শিশু বিশেষজ্ঞ এক বার ডায়েটেসিয়ানের পরামর্শ নেব। তাই কতটা খাওয়ানো হবে তা বুঝতে সাধারণ জ্ঞান কাজে লাগাতে হবে। অকারণে বেশি করে খাওয়াতে শুরু করলে হিতে বিপরীত হবে। বাচ্চাকে সব খাবারই দিতে হবে। বেশি বেশি করে ভাত খাওয়ালে হবে না। তা হলে শরীরে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বেড়ে যাবে। মাছ খেতে দিতে হবে। চিকেন খাওয়াতে হবে। সপ্তাহে এক-দু’দিন রেড মিটও খেতে পারে। তবেই সার্বিক পুষ্টি হবে।
প্রশ্ন: যদি কেউ মোটা ধাতের হয় তা হলে কী হবে?
উত্তর: বাড়ন্ত বাচ্চাকে ২০০০-২২০০ ক্যালোরি পর্যন্ত খাবার দেওয়া যেতে পারে। তবে যদি কেউ ‘ওবিস’ হয়, মোটা হওয়ার প্রবণতা দেখা যায় হয়, তা হলে অবশ্যই ডায়েটিসিয়ান বা পেডিয়াট্রিসিয়ানের পরামর্শ মেনে ডায়েট চার্চ অনুযায়ী খাবার দিতে হবে। তা না হলে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
প্রশ্ন: আজকাল অনেকেই সত্তর বছরের বেশি বাঁচেন। সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকতে তাঁদের করণীয় কী?
উত্তর: আগে মানুষ বেশি বয়সে কুঁজো হয়ে যেত। এখন অনেকে সচেতন হয়েছেন। এই বয়সে হাড়ের ক্ষয় হয়। কাজ না করলেও হাড়ের ক্ষয় হতে পারে। তাই ৫০
বছরের পরে ক্যালসিয়াম সাবস্টিটিউট, ভিটামিন-ই নেওয়া দরকার। নিয়মিত স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ, উপযুক্ত খাবারের প্রয়োজন। বয়স বাড়লে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে। ফলে, অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। তবে সবই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে করবেন।
প্রশ্ন: দীর্ঘায়ুদের কি বিশেষ কোনও সমস্যায় পড়তে হয়?
উত্তর: তেমন কিছু নয়। কোনও ব্যক্তি দীর্ঘদিন নীরোগ অবস্থায় বেঁচে আছেন। খোঁজ নিলে দেখবেন তাঁর পরিবারের অনেকেই সুস্থ ভাবে দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন। মানে ব্যাপারটি কিছুটা বংশগত। তবে সব সময়ে আগে থেকে সচেতন থাকতে হবে। আর শুরুটা ছোট বয়স থেকেই করতে হবে। তবেই বৃদ্ধ বয়সে সুস্থ
থাকা যায়।
প্রশ্ন: বাঙালি ভাত না খেয়ে থাকতে পারে না। এর জন্য বেশি বয়সে কোনও সমস্যায় পড়তে হয় কি?
উত্তর: বাঙালির ভাত না খেলে চলে না এটা কিন্তু ঠিক নয়। বাইরে গেলেই দেখা যায়, সেই বাঙালিই তিন বেলা রুটি খেয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে। শরীর সচল রাখতে গেলে ভাত কম খাওয়াই ভাল। সারা দিন কাজ করতে গেলে ভাত না খাওয়াই ভাল। বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) ২৪-২৫ আটকে রাখতে হবে।
প্রশ্ন: বয়স হলে আর কী সমস্যা হয়?
উত্তর: বয়স হলে সুগার বাড়ে। কারণ, কাজ কম হয়। তা ছাড়া শরীরে ক্যালসিয়াম কমে যায়। হরমোনের প্রভাবের হেরফের ঘটে। থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দেয়। কিডনির রোগ হয়। দু’টি কথা মনে রাখা দরকার। প্রথমত, বেশি করে জল খেতে হবে। দ্বিতীয়ত, ফল খাওয়া বাড়াতে হবে।
প্রশ্ন: কিন্তু ফলে, আনাজে তো কীটনাশক, রাসায়নিকের ভয় রয়েছে?
উত্তর: হুম। এটা এখন বড় সমস্যা। ফল খাওয়ার আগে ১২ ঘণ্টা জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এখন চাষবাসে বেশি পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে মেটাবলিজমে। এনজাইমের ক্ষতি করছে। শাক-আনাজেও কীটনাশক ও রাসায়নিক থাকছে। চাষিরা চান, তাঁদের উৎপাদিত আনাজ যেন দারুণ দেখতে লাগে। তা না হলে বিক্রি হবে না। সে জন্য কৃত্রিম বিষাক্ত রংও ব্যবহার করা হয়। এগুলি শরীরের ক্ষতি করে। কিন্তু বয়স বাড়লে এর থেকে ঝক্কি বেশি থাকে।
প্রশ্ন: এর থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় কী?
উত্তর: আমাদের শিক্ষার বড় অভাব। পড়ার বই ছাড়া অন্য কিছু পড়ার অভ্যাস নেই অধিকাংশের। কী ভাবে শরীর সুস্থ ও সচল রাখতে হবে তা নিয়ে ন্যূনতম পড়াশোনা নেই। যোগাসনের বইপত্র কেনার জন্যও কেউ খরচ করতে চান না। অথচ নিয়মিত যোগাসনে শরীরের বহু সমস্যাই মিটিয়ে ফেলা যায়। আসল কথা, সবাইকে সচেতন হতে হবে। ডাল-ভাত খেয়েও সুস্থ থাকা যায়। তবে শরীরচর্চার কোনও বিকল্প নেই।
প্রশ্ন: তা হলে মানুষ কী ভাবে সচেতন হবে?
উত্তর: প্রতিটি সোসাইটিতে এক-দু’জনকে ভার নিতে হবে। মানুষকে শিক্ষার আলো দেখাতে হবে। শরীর ও জীবনযাপন সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলতে হবে। চিনে এমন ব্যবস্থা আছে। পড়াশোনা না করলে স্বাস্থ্য সচেতনতা আসবে না। সরকারের উদ্যোগের অভাব নেই। সরকারি হাসপাতাল আছে। সেখানে চিকিৎসকেরা আছেন। মনে প্রশ্ন এলে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
সাক্ষাৎকার: অর্পিতা মজুমদার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy