থ্যালাসেমিয়া কি ছোঁয়াচে রোগ? এতে কি আর পাঁচজনের মতো ভাল ভাবে বাঁচা সম্ভব? থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর কি মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী?
এমন বহু প্রশ্নই বারবার উঠে আসে। আসলে এই রোগ সম্পর্কে ঠিক ধারণা না থাকার কারণেই হয়তো এমন নানা প্রশ্ন ঘোরাফেরা করে। তবে চিকিৎসকদের দাবি, থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তরাও আর পাঁচজনের মতো বাঁচতে পারেন। বিয়ে করে ঘর সংসারও করতে পারেন।
থ্যালাসেমিয়া কী ভাবে হয়?
এটি আসলে একটি ব্লাড ডিজ়অর্ডার। এবং জিনগত রোগ। বংশ পরম্পরায় শিশুর দেহে বাসা বাঁধে। এই রোগের ফলে শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমতে থাকে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের রক্তে লোহিত রক্তকণিকা ও হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ মারাত্মক কমে যায়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই রক্তাল্পতার সমস্যা দেখা দেয়।
যদি বাবা-মা দু’জনেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন, সে ক্ষেত্রে সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। তবে থ্যালাসেমিয়া কোনও ভাবেই ছোঁয়াচে নয়।
থ্যালাসেমিয়ার প্রকারভেদ
থ্যালাসেমিয়া সাধারণত দু’ধরনের হয়— আলফা থ্যালাসেমিয়া এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া।
বিটা থ্যালাসেমিয়ার চেয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়া কম তীব্র হয়। আলফা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি প্রকৃতির। বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বেশি। তবে বিশ্বে আলফা থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি।
nআলফা থ্যালাসেমিয়া: এর জন্য ১৬ নম্বর ক্রোমোজ়োমে উপস্থিত আলফা-চেন উৎপাদনকারী জিনের মিউটেশন বা ডিলিশন দায়ী। চারটি জিন দিয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়া চেন তৈরি হয়। বাবা-মায়ের থেকে প্রাপ্ত চারটির মধ্যে এক বা একাধিক জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে আলফা থ্যালাসেমিয়া হয়। জিন যত ত্রুটিপূর্ণ হবে, সমস্যা তত বাড়বে।
একটি ত্রুটিপূর্ণ জিন হলে থ্যালাসেমিয়ার কোনও লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যাবে না। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তাঁর সন্তানের মধ্যে এই রোগ ছড়াতে পারে। দু’টি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যাবে। একে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা আলফা থ্যালাসেমিয়া ট্রেট। তিনটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গ মাঝারি থেকে মারাত্মক আকার ধারণ করে। একে বলা হয় হিমোগ্লোবিন এইচ ডিজ়িজ়। চারটি জিনই ত্রুটিপূর্ণ হলে বলা হয় আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর বা হাইড্রপস ফিটালিস।
nবিটা থ্যালাসেমিয়া: ২টি জিন দিয়ে বিটা থ্যালাসেমিয়ার চেন গঠিত হয়। মা-বাবার কাছ থেকে প্রাপ্ত জিন ত্রুটিপূর্ণ হলেই বিটা থ্যালাসেমিয়া হয়ে থাকে।
একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে কিছুটা কম উপসর্গ দেখা যায়। একে বলা হয় বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেট। দু’টি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে মাঝারি থেকে মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়। একে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর অথবা হাইড্রপস ফিটালিস। নবজাতক যে শিশুদের এই সমস্যা থাকে, তারা কিন্তু জন্মের সময়ে বেশ স্বাস্থ্যবান হয়। তবে জন্মের প্রথম দু’বছরের মধ্যেই এর উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে।
থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ
প্রধানত রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া। হলদে ত্বক বা জন্ডিস, দেহে অতিরিক্ত আয়রন জমা হওয়া, সংক্রমণ, স্প্লিন বা প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, মুখের হাড়ের বিকৃতি বা মঙ্গলয়েড ফেসিস, শারীরিক বৃদ্ধি হ্রাস পাওয়া, পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া, গাঢ় রঙের মূত্র, হৃৎপিণ্ডের সমস্যা ইত্যাদি।
রোগনির্ণয়
এই রোগ নির্ণয়ের জন্য এইচপিএলসি পরীক্ষা করা দরকার। পরীক্ষাটির পুরো নাম হাই পাওয়ার লিকুইড ক্রোমাটোগ্রাফি। এ ছাড়াও কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট, ডিএনএ টেস্ট, হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস টেস্ট রয়েছে। করা হয় হাত ও মাথার এক্স রে-ও।
চিকিৎসা কখন জরুরি
থ্যালাসেমিয়া মাইনরে সাধারণত চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। কারণ তাঁরা মূলত এই রোগের বাহক হন। রোগের উপসর্গ বা লক্ষণ সে ভাবে দেখা যায় না। কিন্তু থ্যালাসেমিয়া মেজরে নিয়মিত চিকিৎসার দরকার।
ব্লাড ট্রান্সফিউশন
এ ক্ষেত্রে রোগীকে নিয়মিত রক্ত বদলাতে হয়। রক্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি ভাগ রয়েছে। শিশুর জন্মের প্রথম ছ’মাসের মধ্যে মেজর থ্যালাসেমিয়ার জন্য সুপার ট্রান্সফিউশন প্রোগ্রাম নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে রক্তে হিমোগ্লোবিন ১২ গ্রাম/ডিএল-এর কমে নামতে দেওয়া হয় না। এই চিকিৎসার ফলে একজন রোগী তিরিশ বছর পর্যন্ত ভাল থাকতে পারেন। অন্য দিকে পূর্ণবয়স্কদের জন্য প্রয়োগ করা হয় হাইপার ট্রান্সফিউশন। এখানে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১০ থেকে ১২ গ্রাম/ডিএল-এর মধ্যে রাখা হয়। আরও একটি পদ্ধতি হল সেফ লেভেল। এই স্তরে সপ্তাহে এক দিন রোগীকে হিমোগ্লোবিনের লেভেল বা স্তর ধরে রাখতে রক্ত দিতে হয়। তবে নিয়মিত রক্ত দেওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। এতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে অতিরিক্ত আয়রন জমে যায়। ফলে যকৃত
বিকল হয়ে রোগীর প্রাণনাশের আশঙ্কাও থাকে।
মেডিকেশন ও সাপ্লিমেন্ট-আয়রন সিলেকশন
দেহের অতিরিক্ত আয়রন বার করে দেওয়ার জন্য আয়রন চিলেটিং দেওয়া হয়ে থাকে। আয়রনযুক্ত খাবার এবং ওষুধ খাওয়া চলবে না। এর সঙ্গে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট হিসেবে দেওয়া হয়ে থাকে। প্রোফেসর ড. মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘‘বাড়তি আয়রন শরীর থেকে বার করে দেওয়া যেমন প্রয়োজন, তেমনই নিয়মিত ফলিক অ্যাসিড এবং ক্যালসিয়াম খাওয়াও জরুরি।’’
প্লীহা ও গল ব্লাডার বাদ
বারবার রক্ত দেওয়ার ফলে অনেকের প্লীহা বড় হয়ে যায়। তখন সেটি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বাদ দিয়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে গল ব্লাডারও বাদ দেওয়া হয়।
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট
অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বা বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন কার্যকর চিকিৎসা। তবে এই চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক জটিল এবং খরচসাপেক্ষ।
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ কী ভাবে করবেন?
মানুষ একটু সচেতন হলেই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ অসম্ভব নয়। যদি স্বামী-স্ত্রী দু’জন থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন অথবা দু’জনের মধ্যে একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক এবং একজন হিমোগ্লোবিন ই-র বাহক হন, সে ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থাতেই প্রায় ২৫ শতাংশ শিশু এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ৫০ শতাংশ শিশুর আবার এই রোগের বাহক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাকি ২৫ শতাংশ শিশু সম্পূর্ণ সুস্থ ভাবে জন্ম নিতে পারে বলে মত চিকিৎসকদের। আবার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজন যদি সুস্থ থাকেন, সে ক্ষেত্রে নবজাতকের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার কোনও সম্ভাবনা থাকে না। তবে থ্যালাসেমিয়ার বাহক হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
ড. মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘‘এই সব কারণে এই রোগের বাহকদের একে অপরকে বিয়ে না করাই ভাল। সেই জন্য বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। এ নিয়ে সকলের মধ্যে সচেতনতা জরুরি। তবেই এই রোগকে অনেকটা দূরে সরিয়ে রাখতে পারব।’’
যদি দু’জন থ্যালাসেমিয়ার বাহকের বিয়ে হয়েও যায়, সে ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় ভ্রুণের রক্ত পরীক্ষা করানো উচিত। গর্ভস্থ সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত কি না, জানার জন্য কোরিয়োনিক ভিলাস স্যাম্পলিং, অ্যামনিওসেনটেসিস, ফিটাল ব্লাড স্যাম্পলিং— এই পরীক্ষাগুলি করা প্রয়োজন।
পরিবারের একজন যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন, তবে বাকিদেরও রক্ত পরীক্ষা করানো উচিত। তবে ড. মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘‘থ্যালাসেমিয়া মানেই জীবন শেষ হয়ে গেল, তা একেবারেই নয়। বরং নিয়মিত চিকিৎসা করালে সুন্দর ভাবে বাঁচা সম্ভব। বিয়ে করে সংসারও করতে পারেন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীরা। বাচ্চা হওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যা নেই। তবে নিজেকেই নিজের যত্ন নিতে হবে। সঙ্গে একটু সচেতন হতে হবে, যাতে আর কোনও থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু না জন্মায়।’’
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য আরও বেশি প্রচার দরকার। প্রয়োজন মানুষকে সচেতন করাও। তবেই হয়তো এই রোগ থেকে মুক্তি মিলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy