Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

রোজ পাতে বিষ খেয়ে নীলকণ্ঠ মহানগরও

জলে, স্থলে, কোথাও রেহাই নেই! সর্বত্র তার করাল গ্রাস! পানীয় জলের গণ্ডি ছাড়িয়ে আর্সেনিকের বিষ যে খাবারেও ঢুকে পড়ছে, অনেক দিন যাবৎ বিজ্ঞানীরা সে হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছেন। এ বার কেন্দ্রীয় সরকারের গবেষণা-প্রকল্পেও ধরা পড়ল বিপদের ছবিটা। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, চাষে এবং মৎস্য ও গবাদি পশু-পাখি পালনে আর্সেনিকযুক্ত জল যথেচ্ছ ব্যবহারের দরুণ বিষাক্ত রাসায়নিকটি দুধ-মাংস-সব্জিতেও থাবা বসাচ্ছে, ভেড়ির মাছও বাদ যাচ্ছে না। যার সূত্রে একের পর এক জনপদ আক্রান্ত হচ্ছে কালান্তক দূষণে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:২০
Share: Save:

জলে, স্থলে, কোথাও রেহাই নেই! সর্বত্র তার করাল গ্রাস!

পানীয় জলের গণ্ডি ছাড়িয়ে আর্সেনিকের বিষ যে খাবারেও ঢুকে পড়ছে, অনেক দিন যাবৎ বিজ্ঞানীরা সে হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছেন। এ বার কেন্দ্রীয় সরকারের গবেষণা-প্রকল্পেও ধরা পড়ল বিপদের ছবিটা। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, চাষে এবং মৎস্য ও গবাদি পশু-পাখি পালনে আর্সেনিকযুক্ত জল যথেচ্ছ ব্যবহারের দরুণ বিষাক্ত রাসায়নিকটি দুধ-মাংস-সব্জিতেও থাবা বসাচ্ছে, ভেড়ির মাছও বাদ যাচ্ছে না। যার সূত্রে একের পর এক জনপদ আক্রান্ত হচ্ছে কালান্তক দূষণে।

কেন্দ্রীয় সূত্রের খবর, ইতিমধ্যে দেশের ৩৬ কোটি মানুষের খাদ্য-শৃঙ্খল আর্সেনিকের কবলে। এবং আর্সেনিক প্রকোপমুক্ত এলাকার বাইরেও তার দাপট ক্রমবর্ধমান। এক গবেষকের কথায়, “খোলা বাজারে বিকোনো সব্জি, মাছ বা মাংসে তো আর উৎপাদনস্থল লেখা থাকে না। তাই তাতে আর্সেনিক আছে কি না, দেখে বোঝা সম্ভব নয়।”

কাজেই খাদ্য-শৃঙ্খলে আর্সেনিক ঢুকলে বিপদ স্বভাবতই বহু গুণ বেশি। কী ভাবে এটা হচ্ছে, আর এর প্রতিকার কী হতে পারে, তা খুঁজতে গবেষণায় নেমেছে কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর), ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (আইসিএআর)-এর মতো কেন্দ্রীয় সংস্থা। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পশু ও মৎস্য-বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়, সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলকাতার ডিএনজিএম রিসার্চ ফাউন্ডেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানও তাতে সামিল। খাদ্য-শৃঙ্খলে আর্সেনিক আগ্রাসনের নানা চিত্র তাদের বিবিধ গবেষণা-প্রকল্পে গত ক’বছর যাবৎ ধরা পড়ছে। এ নিয়ে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলনে আলোচনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারকেও অবহিত করা হয়েছে।

গবেষকেরা বলছেন, গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে নবগঠিত পলিস্তরের মধ্যে আর্সেনিক রয়েছে। দিনের পর দিন ভূগর্ভের জলস্তর ক্ষয় হতে সেটা উপরে উঠে এসেছে। এবং আর্সেনিক-কবলিত তল্লাটে ভূগর্ভস্থ জল দিয়ে সেচ, গবাদি পশু-পাখি পালনের কাজ অবাধে চলতে থাকায় ধান, সব্জি, মাছ, পশুর মাংস, দুধ ও পাখির মাংস-ডিমেও আর্সেনিক ঢুকে পড়ছে। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুপ্রদীপ সরকারের কথায়, “ভেড়িতে ভূগর্ভস্থ জলে মাছ-চাষ হওয়ায় রুই-কাতলা-মৃগেল-বাটার মতো বাঙালির পাতের স্থায়ী চরিত্রের শরীরেও আর্সেনিক ঢুকছে।”

বিষের প্রকোপ কোথায় কোথায় বেশি?

ভূতত্ত্ববিদদের বক্তব্য: মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বর্ধমান, হাওড়া, হুগলি ও দুই ২৪ পরগনা সাধারণ ভাবে পশ্চিমবঙ্গের এই আট জেলা আর্সেনিকপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত হলেও ইদানীং কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলেও আর্সেনিকের প্রবল উপস্থিতি মালুম হচ্ছে। জলসম্পদ উন্নয়ন দফতরের অধীন রাজ্য জল অনুসন্ধান দফতরের (স্যুইড) রিপোর্ট অনুযায়ী, ইএম বাইপাসের দু’ধার থেকে শুরু করে রাজারহাট-নিউটাউন, গড়িয়া, যাদবপুর, টালিগঞ্জ, লেক গার্ডেন্স, ঢাকুরিয়া, গড়িয়াহাট, পার্ক সার্কাস, শিয়ালদহ, বেলেঘাটা, তালতলা, বেহালা, তারাতলা, খিদিরপুর সর্বত্র ছড়িয়েছে আর্সেনিক। প্রসঙ্গত, বর্ধমান-নদিয়া-হাওড়া-হুগলির পাশাপাশি বাইপাসের দু’ধারের এলাকা ও রাজারহাট থেকে প্রচুর শাক-সব্জি, মাছ, মাংস রোজ কলকাতার বাজারে আসে। তার মাধ্যমে মহানগরের বাসিন্দারা আর্সেনিক দূষণের শিকার হচ্ছেন।

পড়শি রাজ্যগুলোতেও বিপদ কিছু কম নয়। গঙ্গা অববাহিকার ঝাড়খণ্ড-বিহার-উত্তরপ্রদেশ, ব্রহ্মপুত্র নদ ও ইম্ফল নদীর অববাহিকার অসম-মণিপুর ও ছত্তীসগঢ়ের রাজনন্দগাঁও জেলায় আর্সেনিকের প্রবল প্রকোপ। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব দি টক্সিকোলজিক্যাল রিসার্চ (আইআইটিআর)-এর বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর নটিয়াল এবং ন্যাশনাল বটানিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এনবিআরআই)-এর বিজ্ঞানী রুদ্রদেও ত্রিপাঠীর দাবি: গঙ্গা ও গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় অগভীর নলকূপ মারফত মাটির তলা থেকে যত জল তোলা হয়, তাতে চাষের মাঠে ফি বছর আনুমানিক হাজার টন আর্সেনিক ঢুকে পড়ে।

পরিণামে ওখানকার মাঠের ফসল দিন দিন বিষিয়ে উঠছে। পশ্চিমবঙ্গের তিন জেলা হুগলি (চুঁচুড়া), বর্ধমান (পূর্বস্থলী) ও নদিয়ার (বীরনগর) বেশ কিছু চাষের জমির মাটি ও তাতে সরবরাহ করা সেচের জলের নমুনা পরীক্ষা করে সিএসআইআরের বিশেষজ্ঞেরা তো রীতিমতো প্রমাদ গুনেছেন। মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকে সেগুলি ভরপুর!

আরও ভয়ঙ্কর তথ্য মাটি থেকে ফসলে প্রবেশকারী আর্সেনিকের ৭৫ ভাগই হল অজৈব, যা কিনা মানবশরীরে ঢুকে আর্সেনিকোসিস রোগ বাধায়।

“ভূগর্ভের উপরের স্তরে আর্সেনিক ছড়িয়ে পড়লে ভীষণ বিপদ। পানীয় জল থেকে আর্সেনিক দূর করার উপায় রয়েছে। কিন্তু ভূস্তরের উপরিভাগের আর্সেনিকমুক্তির তেমন পদ্ধতি এখনও অধরা।” জানাচ্ছেন নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র।

পরিত্রাণের সম্ভাবনা কি নেই-ই?

চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা অবশ্য কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছেন।

(চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

arsenic water food pollution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy