‘ডি বাপি’র মটন বিরিয়ানি। নিজস্ব চিত্র
প্রথমে পড়বে তেজপাতা, তার উপর সাজানো হবে রান্না-করা মটনের পিস। তার উপর চাপবে ভেজে-নেওয়া আলু। তারপর থরে থরে সন্তর্পণে সাজানো হবে হলুদ আর সাদা সরু চালের ভাত। মিশবে আরও নানা উপাদান। সব শেষে দমে বসানো হবে হাঁড়ি। হাঁড়ি থেকে ৩০ মিনিট পর যা বেরোবে, তা শুধুই এক সুস্বাদু পদ নয়, বরং এক বিশেষ অনুভূতি!
সেই অনুভূতির নাম— বিরিয়ানি!
এমন ভোজনরসিক খুঁজে বার করা মুশকিল, যিনি বিরিয়ানি পছন্দ করেন না। যে কোনও দিন, যে কোনও মুহূর্তে বিরিয়ানি খেতে বেশির ভাগ মানুষই এক কথায় রাজি। বিরিয়ানির টানে মানুষ কত কী-ই না করে! কিন্তু তা বলে একেবারে গোলাগুলি? তা-ও হল শেষমেশ। ব্যারাকপুরের ‘ডি বাপি বিরিয়ানি’র দোকানে!
দিনেদুপুরে দু’-দুটো গুলি! আহত দুই। হঠাৎ বিরিয়ানির দোকানে এমন কাণ্ড কেন? ‘ডি বাপি’র মালিকের বহু বছর ধরে মাংসের দোকান। বিরিয়ানির ব্যবসাও নাকি গত ১২ বছর ধরে। পাঁচ মাস হল আরও একটি শাখা খুলেছেন সোদপুরে। তিনি মনে করেন, তাঁর কারও সঙ্গে শত্রুতা নেই। কিন্তু তাঁর এই সাফল্য হয়তো কারও কুনজরে পড়েছে। তাতেই এই কাণ্ড।
কেন বিরিয়ানি তাঁকে এমন সাফল্য দিল? সেই সাফল্য এতটাই যে, অসূয়ার বশবর্তী হয়ে লোকে ভরদুপুরে এসে গুলি চালিয়ে খদ্দের হটাতে গেল! দোকানের কর্ত্রী বাপি দাসের স্ত্রী বললেন, ‘‘কেন হল, আমরাও বুঝতে পারছি না। সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে সৎ ভাবে ব্যবসা করছি। কার মনে হিংসে আছে, কী করে বলি! পুলিশকে জানিয়েছি। তারা কিছু সাহায্য না করলে আমরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাব।’’
একেবারে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যেতে হবে! এমন তো হতেই পারে, অন্য কাউকে লক্ষ্য করে গুলি চলেছিল। তাঁরা আসল লক্ষ্য নন। ‘‘না-না!’’ তিনি সবেগে ঘাড় নাড়েন, ‘‘দিনেদুপুরে দুটো গুলি কেউ কি ভুল করে চালায়? আসলে বিরিয়ানিটা ভাল তো! তাতেই লোকের এত গায়ের জ্বালা!’’
তা হলে তো সেই ‘ভাল’ বিরিয়ানি চেখে দেখতে হয়! বুধবার আনন্দবাজার অনলাইন হাজির হল ‘ডি কোম্পানি’র বিরিয়ানির দোকানে।
কল্যাণী হাইওয়ে থেকে খুব বেশি দূর নয়। রাস্তার ধারের ধাবার মতো। তখন বেলা সাড়ে ১২টা। মোটে আধ ঘণ্টা হল দোকান খুলেছে। দোকানের বাইরে ‘সুইগি’র কিছু কর্মী অপেক্ষা করছেন অর্ডার নিয়ে যাওয়ার জন্য। ভিতরে বসার ব্যবস্থা নেহাতই ছাপোষা। জনা চল্লিশের মতো বসার জায়গা। তখন অবশ্য বেশির ভাগই খালি। শুধু তিনজন ব্যাঙ্ককর্মী বসে খাচ্ছেন। দু-তিন মিনিট বসে থাকার পর এক কর্মচারী এগিয়ে এসে বললেন, কাউন্টারে অর্ডার দিয়ে বিল মিটিয়ে তবেই খাবার পাওয়া যাবে। কাউন্টারের দিকে যেতে কানে এল, ‘‘ওই যে ঠিক ও দিক থেকে গুলিগুলো চলেছে। আর একটু হলেই এ দিকে এসে লাগত!’’
কর্মীদের কণ্ঠে এখনও আতঙ্ক। বিরিয়ানি আর চিকেন চাপের দাম কাউন্টারের পিছনে একটি বোর্ডে লেখা। খুব বেশি নয়, ৫-৬ টাই আইটেম। মটন বিরিয়ানি ২৯০ টাকা। সেটাই অর্ডার দেওয়া গেল। বিল নিয়ে টেবিলে রাখতে রাখতেই একজন কর্মী এগিয়ে এসে বিল দেখে জানতে চাইলেন, ‘‘মটন পিস কেমন হবে? সলিড না চর্বি দেওয়া?’’ প্রশ্নটা একটু অবাক-করা। কোন বাঙালি ‘সলিড মটন’ ছে়ড়ে চর্বি দেওয়া বেছে নেবে!
অর্ডার নিয়ে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খাবার এল সস্তার কাগজের প্লেটে। সঙ্গে পুদিনার চাটনি দেওয়া অল্প স্যালাড। এর জন্যই তা হলে গোলাগুলি! প্রথম গ্রাস মুখে ঢুকল। কিন্তু গলা দিয়ে নামার আগেই আশাভঙ্গ। অন্তত আমার মতো তাঁদের কাছে, বছরভর যাঁরা রয়্যাল, আমিনিয়া, জিশান, আরসালান, জাম জাম, আলিয়া, ইন্ডিয়া রেস্তোরাঁর মতো নানা বিরিয়ানির মন্দিরে ঢুঁ মারেন।
বিরিয়ানি বিচারের তিন-চারটে দিক রয়েছে। ভাত হতে হবে সরু। রান্না হবে এমন ভাবে, যাতে তেল চুপচুপে হবে না, অথচ মুখের ভিতরে এমন ভাবে গলে যাবে, যে সালান বা রায়তা দিয়ে খেতে হবে না। হায়দরাবাদি বা অন্য দক্ষিণী বিরিয়ানির সঙ্গে কলকাতার বিরিয়ানির এটা একটা মস্ত বড় ফারাক।
দ্বিতীয় দিক অবশ্যই মাংস। মটন এমন নরম হবে যে দাঁত দিয়ে কাটতে হবে না। অথচ মাংসের বোঁটকা গন্ধও বেরোবে না। কলকাতার শ্রেষ্ঠ স্ট্রিটফুডের মধ্যে বহু বছর ধরেই বিরিয়ানি অন্যতম। তবে নামী রেস্তোরাঁর সঙ্গে রাস্তার ৩০-৫০ টাকার বিরিয়ানির সবচেয়ে বড় ফারাকের জায়গা এই মাংসই। বেশির ভাগ রাস্তার বিরিয়ানির মাংস ভাল হয় না বলেই লোকমুখে তা ‘কাউয়া বিরিয়ানি’ (অর্থাৎ, কাকের মাংস দিয়ে তৈরি বিরিয়ানি) নামে পরিচিত।
‘ডি বাপি’র বিরিয়ানির মাংস আসে নিজেদের দোকান থেকে। তাই মাংস খারাপ হওয়ার কথা নয়। মটন খেতে মন্দ নয়, তবে বিরিয়ানির ভাত তেমন মন কাড়ল না। কলেজবেলায় হাতখরচের জন্য যখন সিনেমা-সিরিয়ালের প্রোডাকশনে টুকটাক কাজ করতাম, তখন বেশির ভাগ দিন দুপুরের খাবারে আসত বিরিয়ানি। প্রায়শই রাস্তার ‘কাউয়া বিরিয়ানি’। তবে ভাগ্যজোরে কোনও ভাল প্রোডাকশন ম্যানেজারের হাতে পড়লে আনওয়ার শাহ রোডের কিছু বাছাই করা দোকানের বিরিয়ানি আসত। সেগুলো খেতে নেহাত মন্দ লাগত না। ‘ডি বাপি’র বিরিয়ানি সেই স্মৃতি খানিক উসকে দিল।
বিরিয়ানি যাচাই করার আরও একটা দিক হল আলু। অনেকের কাছে আলু তেমন পাত্তা না পেলেও নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ্ ঘরানার বিরিয়ানির ভক্তদের কাছে আলুর কদরই আলাদা। ভারতের আর কোনও জায়গার বিরিয়ানিতে আলু মিলবে না। কিন্তু কলকাতার বিরিয়ানিতে আলু না পড়লে হুলুস্থুল বেধে যাবে। বিরিয়ানির আলু এতটা ভাজা হবে না যে, বাদামি দাগ পড়বে। আবার এতটাই নরম হবে যে, মুখে পুরলেই তা থেকে বিরিয়ানি স্বাদ চলকে বেরোবে। ‘ডি বাপি’র বিরিয়ানির সবচেয়ে হতাশাজনক জায়গা এটাই।
খাওয়া যখন শেষ হল, তখন ভিড় খানিক বেড়েছে। দোকানের বাইরেই পাওয়া গেল বাপি দাসের স্ত্রীকে। তিনি অবশ্য দাবি করলেন, গুলি-কাণ্ডের পর আতঙ্কে গ্রাহকের সংখ্যা কমে গিয়েছে। না হলে আরও ভিড় থাকে এই সময়ে।
খুব বেশি কথা বলার সময় ছিল না মালিক-মালকিনের। দোকানের সামনে পুলিশের প্রহরা থাকার কথা। কিন্তু সেটা চোখে পড়ল না। সত্যিই কি কোনও ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী গুলি-টুলি চালিয়ে আতঙ্ক তৈরি করে খদ্দের বাগাতে চাইছে? কে জানে! পুলিশ নিশ্চয়ই তদন্ত করে বার করবে।
ফেরার পথে ঢুঁ মারলাম ‘দাদা বৌদির বিরিয়ানি’র দোকানে। আদি দাদা বৌদির দোকানের দু’ধারে বিশাল লাইন! সেটা ছেড়ে দাদা বৌদির এসি রেস্তোরাঁর দিকে যাওয়া গেল। যাঁরা পার্সেল নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছেন, তাঁদের ভিড়ই রাস্তা এমন ভাবে জুড়ে রয়েছে যে, অন্য কেউ যাতায়াত করতে পারছেন না। কোনওক্রমে সেই ভিড় এড়িয়ে পৌঁছলাম রেস্তরাঁয় ঢোকার লাইনে। বুধবার, কাজের দিনের দুপুরেও যে এতটা লম্বা লাইন হতে পারে? বিরিয়ানির জন্য?
প্রায় এক ঘণ্টা পর ভিতরে ঢুকে বিরিয়ানি পাওয়া গেল অবশেষে। এক চামচ মুখে দিয়েই মনে হল— গুলিটা কি তা হলে ভুল জায়গায় চলেছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy