বিবি। ছবি: সর্বজিৎ সেন
আরব্য রজনীর গল্পে বাজার জুড়ে সাজানো সেই পসরার কথা মনে পড়ে? যেখানে বাতাসে মিশে থাকত বসরাই গোলাপের গন্ধ, বাখরখানির স্বাদ, চোখ জুড়িয়ে যেত অঙ্গরাখা থেকে রুপোর বাজুবন্ধে। অনেকটা সে ভাবেই সেজে উঠেছিল কলকাতা কেটলের পঞ্চম এডিশন। সম্প্রতি কলকাতার বালিগঞ্জ পার্কে আয়োজন করা হয়েছিল এমনই এক প্রদর্শনীর। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডিজ়াইনার ও আর্টিজ়নরা জড়ো হয়েছিলেন তাঁদের সম্ভার নিয়ে।
রুপোর গয়না, ব্লক প্রিন্টের চাদর, কুশন কভার, পোশাক, ম্যাক্রামের প্লান্টার, পেপারবোর্ডের অন্দরসজ্জা সামগ্রী, রিসাইকল কাপড় থেকে তৈরি পোশাক, কাপকেক, পেস্ট্রি, চিত্রকলা দিয়ে সজ্জিত সেই প্রদর্শনী তখন ‘সব পেয়েছির দেশ’। উল্লেখ্য বিষয় হল, প্রদর্শনীর প্রত্যেকটি জিনিস পরিবেশবান্ধব উপায়ে বানানো। এক কণাও সিন্থেটিক বা প্লাস্টিকের ব্যবহার নেই তাতে। প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, পরিবেশের ক্ষতি না করে স্থানীয় শিল্পকে আন্তর্জাতিক ডিজ়াইনের দরবারে তুলে ধরাই ছিল কলকাতা কেটল-এর উদ্দেশ্য।
ডালিভরা শিল্পসামগ্রী
প্রদর্শনীর দরজায় পৌঁছতেই দেখা মিলল একজনের সঙ্গে। তিনি গ্লাসে করে অতিথিদের জল পরিবেশন করছেন। তবে যে সে জল নয়, এই জলেরও মহিমা আছে। হাইড্রোজেন ওয়াটার হজমশক্তি বাড়ায় ও শরীর সুস্থ রাখতে কার্যকর। জলের স্টল পার হয়ে একটু এগোতেই দেখা মিলল রিসাইকলড কাগজ দিয়ে তৈরি পেনসিলের। বর্জ্য কাগজ দিয়ে তৈরি এই পেনসিলের গায়ে হাতে করে নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অন্দরসজ্জার নানা সম্ভারও মিলল সেখানে, যার অনেকটাই বর্জ্য রিসাইকল করে তৈরি। পশ্চিমবঙ্গ বধির সংস্থার তৈরি কোস্টার, হাতে আঁকা পাট ও কাপড়ের ব্যাগও ছিল সম্ভারে। তার পাশেই দেখা মিলল রুপোর নাকফুল, চাঁদবালি, কর্ণফুল, বাজুবন্ধ, চোকারের। মিনে করা কাজে রুপোর গয়নায় আফগান জুয়েলরির প্রভাব। পরিবেশবান্ধব অনুষ্ঠানে সবুজের দেখা মিলবে না, তা কি হয়? নানা রকম গাছও ছিল প্রদর্শনীর অংশ। তবে সে গাছ কোনও প্লাস্টিক প্লান্টারে নয়, জুট ব্যাগ, ম্যাক্রামের প্লান্টারে শোভা বাড়িয়েছে প্রদর্শনীর। তার সঙ্গে ছিল বাগান সাজানোর ছোট্ট পাখি বা বাবুই পাখির বাসার মিনিয়েচার। আপসাইকলড পোশাকের সম্ভারও ছিল প্রদর্শনীর বিভিন্ন স্টলে। সুগন্ধি মোমবাতি, অঙ্গ প্রসাধনী থেকে শুরু করে পেন্টিং, ডোকরার পুতুল, রকমারি ফ্রিজ ম্যাগনেটের মতো নানা সংগ্রহযোগ্য জিনিসও ছিল তালিকায়। ব্রাইডাল কালেকশনে পোশাক ও গয়নার বিপুল সম্ভার রীতিমতো নজরকাড়া। ড্যাঙ্গলার, নেকলেসের সঙ্গে নানা রকম চুলের কাঁটা, চিরুনি যে কোনও সময় আপনার কেনাকাটার তালিকায় ঢুকে পড়তে পারে।
পোশাক ও বিবি রাসেল
তবে প্রদর্শনীর বেশির ভাগ পোশাকের স্টলে চোখে পড়ল আপসাইকল করা কাপড়ের ব্যবহার। কোথাও বাংলার কাঁথা শিল্পের মতো একাধিক কাপড়ের টুকরো প্যাচের মতো ব্যবহার করে যেমন তৈরি হয়েছে জ্যাকেট, স্কার্ফ, পোশাক। তবে এ বারের প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষণ ছিল বাংলাদেশের জনপ্রিয় পোশাকশিল্পী বিবি রাসেলের শো। একটি ফ্যাশন শোয়ের আয়োজন করা হয়েছিল প্রদর্শনীতে। সেখানে হ্যান্ডুলুম শাড়ি পরে হাঁটলেন কলকাতা রোটারি ক্লাবের সদস্যরা। বিবির কথায়, “আমাদের বাংলায় এত রকম ফ্যাব্রিক রয়েছে, যা খুব ব্যয়সাপেক্ষও নয়। ফ্যাশন সকলের কাছে পৌঁছে দিতে এই ফ্যাব্রিকগুলো নিয়ে কাজ করতে চাই। এখন যেমন আমি ধনেখালি নিয়ে কাজ করছি। একে তো ভীষণ ভাল মানের কাপড়। তার উপরে পরাও সুবিধে। এখন মাড় দেওয়া শাড়ি কেউ তেমন পরতে চান না। আমিও সে ভাবেই ধনেখালির পোশাক তৈরি করছি। আজকে এই শাড়ির সঙ্গে সদস্যরা যে গয়না পরেছেন, তাও কিন্তু কাপড়ের টুকরো দিয়ে তৈরি।”
সে দিনের শোস্টপার ছিলেন নয়নিকা চট্টোপাধ্যায়। নয়নিকাকে দেখা গেল ল্যাভেন্ডার রঙা জামদানিতে। র্যাম্পে সব সদস্যেরই শাড়ি পরার কায়দা ছিল অভিনব। শাড়ির উপরে কোমরে আলাদা কাপড়ের টুকরো দিয়ে ড্রেপ করা হয়েছিল, যা পুরো লুকই বদলে দিয়েছে।
তবে কলকাতা কেটলের এই প্রদর্শনীর আয়োজনের একটা মহৎ উদ্দেশ্যও রয়েছে। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে রোটারি ক্লাব যে ফান্ড সংগ্রহ করবে, তা চলে যাবে প্রান্তিক শ্রেণির পুরুষ ও মহিলাদের প্রশিক্ষণের জন্য। হাতেকলমে শিখিয়ে শিল্পসৃষ্টির কাজে তাঁদের স্বনির্ভর করে তোলা এই প্রদর্শনীর অন্যতম উদ্দেশ্য। শিল্পকে মাধ্যম করে শিল্পকে হাতিয়ার করে সমাজের সকল শ্রেণির জীবনযাপন যদি সহজ করে তোলা যায়, তার চেয়ে বড় সাফল্য আর কী হতে পারে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy