—প্রতীকী চিত্র।
তাঁদের প্রথম কন্যাসন্তান বধির। এর পরে ছেলে হয় পূর্ব বর্ধমানের গলসি-২ ব্লকের একটি গ্রামের বাসিন্দা, অসীমকুমার মণ্ডল এবং তাঁর স্ত্রী তন্দ্রার। কিন্তু জন্মের দেড় বছরের মাথায় বোঝা যায়, সেই ছেলেও বধির! এমন দুই সন্তান নিয়ে কি লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব? সর্বশিক্ষা মিশনের শিক্ষাবন্ধু হিসাবে কাজ করে মাসে আট হাজার টাকা রোজগার করা অসীম এবং তাঁর স্ত্রী ঠিক করেন, দুই সন্তানকে মেরে নিজেরাও ঘুমের ওষুধ খাবেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হয়নি।
পরিচিতেরা বলেন, ভাগ্যিস হয়নি। বধির সেই মেয়ে এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। ছেলে পাশ করেছেন ডাক্তারি পড়ার প্রবেশিকা পরীক্ষা ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্ট (নিট)। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ থেকে এখন তিনি ডাক্তার হওয়ার পথে।
বুধবার, মে দিবসে ব্যান্ডেলে ‘প্রতিবন্ধী কল্যাণ কেন্দ্র’-র একটি আলোচনাচক্রে ব্রজকিশোর মণ্ডল নামে সেই তরুণের বাবা অসীম বলেন, ‘‘দেড় বছর বয়সে ছেলের থেরাপি শুরু হয়েছিল ব্যান্ডেলের এই প্রতিবন্ধী কল্যাণ কেন্দ্রে। এখান থেকেই ওকে কানের যন্ত্র দেওয়া হয়। তত দিনে আমাদের মেয়ে এই কেন্দ্রের থেরাপির জোরেই সবে ‘বাবা’ বলা শিখেছে। মেয়ে পারছে দেখে ভরসা বেড়ে যায়। আজ আমার ছেলে যেখানে পৌঁছেছে, তার জন্য এই কেন্দ্রের অবদান অপরিসীম। খুব দ্রুত চিহ্নিত করা গেলে যে বধিরতা নিয়েও সাফল্য পাওয়া যেতে পারে, সেটা আমার ছেলের সময়েই দেখেছি।" একই রকম দাবি, প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে টেবল টেনিস প্রশিক্ষক হওয়া এক তরুণীর পরিবারেরও।
দ্রুত চিহ্নিত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে যে এই ধরনের যে কোনও সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে সাফল্য পাওয়া সম্ভব— এই বার্তা দিয়েই এ দিনের আলোচনাচক্রের আয়োজন করা হয়েছিল বলে দাবি প্রতিবন্ধী কল্যাণ কেন্দ্রের সদস্যদের। সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘১৯৭৪ সাল থেকে আমাদের সংস্থা কাজ করে চলেছে। ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত এক বছর ধরে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এ দিনের আলোচনাচক্রে বিষয় রাখা হয়েছিল— সমস্যা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরাই প্রথম সহযোগী।’’ সংস্থার আর এক সদস্য, মনোরোগ চিকিৎসক নন্দিনী সেন বললেন, ‘‘যত দ্রুত সমস্যা চিহ্নিত করা যাবে, ততই ভাল। জন্মের পর থেকে বাচ্চার বৃদ্ধির যে মাইলস্টোনগুলো থাকে, সেটা ঠিক ঠিক সময়ে হচ্ছে কি না, খেয়াল রাখতে হবে। এর মধ্যে সমস্যা চোখে পড়লেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’’
এ দিনের আলোচনাচক্রে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা সিদ্ধার্থ নিয়োগী, স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ সচিব দেবল ঘোষ, হুগলি জেলার চিফ মেডিক্যাল অফিসার ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বেশ কয়েক জন চিকিৎসক। সিদ্ধার্থ বলেন, ‘‘সরকারি স্তরে যেমন নানা সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তেমনই এই নিয়ে দারুণ কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যেরা। দু'পক্ষকেই হাতে হাত রেখে কাজ করতে হবে।’’ তাঁর পরামর্শ, এখন জেলা স্তরের হাসপাতালেও বাচ্চার স্ক্রিনিংয়ের বন্দোবস্ত রয়েছে। ফলে সমস্যার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে প্রথমেই নবজাতকের স্ক্রিনিং করাতে হবে। বিশেষ ভাবে সক্ষমদের সাফল্যের কাহিনি শুনে এমন সাফল্যের ঘটনা আরও বেশি করে সামনে আনার অনুরোধ জানান দেবল ঘোষ। আলোচনায় উঠে আসে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট অস্ত্রোপচারের প্রসঙ্গ।
চিকিৎসকেরা জানান, এই প্রক্রিয়ায় একটি বৈদ্যুতিন যন্ত্র, যার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দু’টি অংশ রয়েছে, সেটি বসানো হয় কানে। এই যন্ত্র ককলিয়ার স্নায়ুকে (এর জন্যই শুনতে পাওয়া যায়) উদ্দীপ্ত করে তোলে শব্দের অনুভূতি জাগানোর জন্য। চিকিৎসকেরা জানান, এ ক্ষেত্রে সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। যত তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হবে, ততই দ্রুত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে শিশু। তাই আগে দরকার রোগ নির্ণয় করা। তবে এই অস্ত্রোপচারে বেশি খরচের প্রসঙ্গও ওঠে। দেবল দাবি করেন, ‘‘প্রতি বছর অন্তত ৬০টি শিশুর ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট অস্ত্রোপচার হচ্ছে সরকারি খরচে।’’ আলোচনায় উপস্থিত, ইএনটি সংগঠনের সেক্রেটারি স্নেহাশিস বর্মণ বলেন, ‘‘এক বিশেষ গবেষণা চলছে। সেই গবেষণায় সাফল্য মিললে এই অস্ত্রোপচারের খরচ কমে আসবে অনেকটাই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy