বাঙালির পাতে খাঁটি ইটালিকে নামিয়ে আনলেন বাংলার ছেলে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
খাঁটি বাঙালির ছেলে। পৈতৃক বাড়ি আসানসোল। আর তিনিই কিনা দেশের নামজাদা রাধুঁনিদের ইটালি, স্পেন, জাপানের রন্ধনপ্রণালী শিখিয়ে বেড়াচ্ছেন। পোস্ত নয়, পাস্তা রান্নাতেই তাঁর বিশেষত্ব। ইটালির অলিগলিতে ঘুরে ‘নোন্না’ বা ঠাকুমাদের পাস্তা রান্নার প্রণালী আয়ত্ত করেছেন। ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলির মা-ঠাকুমাদের প্রাচীন রেসিপি খুঁজে বার করে তাতে বাঙালি ছোঁয়া দিয়েছেন অবলীলায়। তাঁর হাতের পাস্তায় খাঁটি ইটালিরই স্বাদ। সেখানে কলকাত্তাইয়া ধাঁচের ইটালীয় ক্যুইজ়িনের কোনও মিলই নেই। কে তিনি?
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলেও নিজেকে ‘প্রথাগত রাঁধুনি’ বলতে ভালবাসেন না। তিনি রন্ধনশিল্পী। ঘনিষ্ঠমহলে সব্যসাচী গড়াই নামে পরিচিত হলেও দেশ-বিদেশের রাঁধুনিদের দরবারে ‘শেফ স্যাবি’ নামেই সুনাম কুড়িয়েছেন। কলকাতা থেকে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাশ করে পাড়ি দেন মুম্বই। রান্নাই যে হেতু ছিল প্রথম ভাল লাগা, তাই রন্ধনকৌশলেই উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি নেন। তার পর ‘অলিভ কালিনারি অ্যাকাডেমি’-তে প্রশিক্ষণ ও সেখানেই কনসালট্যান্ট শেফের চাকরি। পাশাপাশি, দেশের নানা জায়গায় নিজে শেখা ও শেখানোর কাজও চলতে থাকে।
শেফ বলছেন, “আত্মীয়দের অনেকেই থাকতেন জাপানে। তাই সে দেশে যাতায়াত চলতই। আর সেই সুবাদেই জাপানের নানা জায়গায় ঘুরে স্থানীয়দের রান্না হাতেকলমে শিখেছি। কখনও স্থানীয়দের বাড়িতে গিয়ে আলাপের ফাঁকে তাঁদের রান্নাঘরেও ঢুকতাম। দেখতাম, কী ভাবে রান্না করছেন তাঁরা। কোনও রেসিপি মনে ধরলে লিখে রাখতাম।”
ভিন্দেশি রান্না শুধু শিখলেই তো হবে না, সেই পদটির ইতিহাসও জানতে হবে। আরও গভীরে গিয়ে সেই রন্ধনপ্রণালীর উৎসের অনুসন্ধান করার নেশাই চেপে বসে। তাই চাকরিবাকরি ছেড়ে পাড়ি দেন বিদেশ। প্যারিসের ‘পেস্ট্রি স্কুল’, আমেরিকার ‘কালিনারি স্কুল’ ও ইটালির ‘পাস্তা অ্যাকাডেমি’ থেকেও রান্নাবান্নায় কোর্স করে নেন। ইটালিতে পাস্তা রান্নায় তালিম নেওয়ার সময়েই সেখানকার অনেক বাড়িতে গিয়ে মা-ঠাকুমাদের কাছ থেকেও রান্নার প্রণালী শিখে নেন। তাঁর কথায়, ফুটন্ত গরম জলে সামান্য অলিভ অয়েল ও নুন ফেলে তাতে পাস্তা দিয়ে ভাপে সেদ্ধ করলেই তো শুধু হবে না, নুন-তেল জারিত পাস্তাকে মুড়ে দিতে হবে সস্, ক্রিম ও চিজ়ের মোড়কে। উপর থেকে ছড়াতে হবে নানা রকম হার্ব। পাস্তার আবার নানা প্রকার রয়েছে। রং-রূপ-আকার ভেদে তাদের রন্ধনপ্রণালীও ভিন্ন। সেগুলি কলকাতায় বসে বা দেশের কোনও প্রান্তের রান্নার স্কুলে বসে শেখা সম্ভব নয়। মাঠে নামতেই হবে।
ইটালীয়রা এক সময়ে বিশেষ দোরাম ময়দা দিয়ে পাস্তা বানাতে শুরু করেছিলেন। ইটালি ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের আশপাশে বিভিন্ন আকারের পাস্তা তৈরি হত। কখনও লাসানে, কখনও ভারমিচেলি, কখনও ফিদেয়ো, আবার কখনও ম্যাকারনি। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, আরব দেশে পঞ্চম শতাব্দী থেকেই পাস্তা জাতীয় খাবার পাওয়া যায়, যা তাঁরা দূর দেশে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিতেন। কারণ, শুকনো পাস্তা নষ্ট হত না। এক প্রচলিত মত হচ্ছে, ইউরোপে পাস্তা নিয়ে প্রথমে পৌঁছন আরব বণিকরাই। তবে মত যা-ই হোক, সেই পুরনো পাস্তা আর এখনকার নতুন প্রণালীতে তৈরি ময়দায় তৈরি পাস্তার বর্ণে-গন্ধে, স্বাদে ও গুণে কোনও মিল নেই। সেই গুণ ও সেই স্বাদই ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে বলেই জানালেন শেফ স্যাবি।
তা কী রকম? ক্যাফে মেজ়ুনা-তে পাস্তা রান্না শেখাতে এসেই সেই রহস্য ফাঁস করলেন শেফ। কলকাতার ঝাঁ-চকচকে ক্যাফের একটি প্রান্ত তখন যেন ইটালির কোনও নোন্নার রান্নাঘর। চিজ় ও হার্বের গন্ধে ম-ম করছে। চিমটে দিয়ে শুকনো পাস্তা তুলে গরম জলে ফেলতে ফেলতে শেফ বললেন, “সেই আগের মতো ময়দা আর নেই। এখন সবই ‘জেনেটিক্যালি মডিফায়েড’ বা জিনগত ভাবে পরিবর্তিত। গমের আটা বা ময়দা খেয়ে গ্লুটেন অ্যালার্জিও হচ্ছে অনেকের। তাই বিকল্প হিসেবে মিলেট বা রাগি বেছে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেটা ইটালির বিশেষত্ব নয়। কারণ তাতে স্বাদটাই বদলে যায়। তাই খাঁটি জিনিস ফিরিয়ে আনারই চেষ্টা হচ্ছে। জৈব চাষ নিয়ে সচেতনতার প্রচারও করছি আমরা।”
খাঁটি ‘ইটালীয় সেমোলিনা’ দিয়ে পাস্তা বানিয়ে দেখালেন। অর্থাৎ, বাংলায় ঝুরঝুরে সুজি। ময়দা বা ডিমের ব্যবহারই নেই। নানা রং ও আকারের পাস্তার হরেক পদ থরে থরে সাজানো টেবিলে। শেফ জানালেন, একটিও দোকান থেকে কেনা নয়। সবই হাতে বানানো। পাস্তার রং তৈরি হয়েছে বিটরুট বা অন্য সব্জি দিয়ে। চিজ়, হার্ব— সবই খাস ইটালি থেকে নিয়ে আসা। সস্ বানালেন নিজেই। লাল-সাদা পাস্তার দু’টি টুকরো বিশেষ এক রকম তেল, সস্ ও ঘন চিজ়ে মাখামাখি হয়ে যখন থালায় এল, তার স্বাদের সঙ্গে হালফিলে দোকানে পাওয়া পাস্তার স্বাদের কোনও মিলই নেই। এক টুকরো ইটালিকে যেন বাঙালির পাতে নামিয়ে আনলেন শেফ।
‘সুস্বাদু খাও এবং স্বাস্থ্যকর খাও’— এই হল শেফ স্যাবির মূলমন্ত্র। স্বাস্থ্যকর বলতে, তেলের ব্যবহার কম, রান্নায় চিনির বদলে তিনিও গুড় ব্যবহার করতে ভালবাসেন। স্যাবির হাতের পালংশাকের পুর ভরা শিঙাড়া খেলে আলুর কথা মনেও পড়বে না। অথচ ঘরোয়া উপকরণ দিয়েই একেবারে কম তেলে শুকনো করে সেই শিঙাড়া ভেজেছেন স্যাবি। তাকে ঘিরে দিয়েছেন ইটালীয় সসে্। রসুন কুচি, অলিভ তেল, উপর থেকে ছড়ানো বেসিলে মাখামাখি ভেগান জ়ুকিনি স্প্যাগেটিকে দিব্যি হোয়াইট সসে্ মিলিয়ে দিয়েছেন। শামুকের খোলের মতো দেখতে পাস্তার ভিতরে মটন কিমার পুর বাঙালির মাংসের শিঙাড়াকেই মনে করিয়ে দেবে। তফাত হচ্ছে, শিঙাড়া ছাঁকা তেলে ভাজতে হয়, আর ইটালীয় পুর ভরা পাস্তা ভাপিয়ে রান্না হয়। স্বাস্থ্যের দিক থেকে তাই অনেকটাই এগিয়ে। স্বাদে সাহেবিয়ানা থাকলেও স্বাস্থ্যের সঙ্গে আপস করতে একেবারেই রাজি নন বাংলার শেফ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy