রাজ্য সরকার পুরুলিয়া হোমিওপ্যাথি মেডিক্যাল কলেজটি পিপিপি মডেলে খোলার চিন্তা ভাবনা করছে। সোমবার হুড়া ব্লকের লধুড়কার প্রশাসনিক সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ কথা জানানোর পরে সরকারের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। আচমকা এত দিন পরে মুখ্যমন্ত্রীর এই মত বদল কেন? তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কলেজের শিক্ষক-সহ বিভিন্ন মহল।
২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে পুরুলিয়া-২ ব্লকের হুটমুড়ায় এমনই এক প্রশাসনিক সভায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, রাজ্য সরকার এই কলেজটিকে অধিগ্রহণ করবে। কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ মণীন্দ্রনাথ জানা বলেন, “সেই সভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকার এই কলেজটি বন্ধ করে দিয়েছে। রাজ্য সরকার এই কলেজটি অধিগ্রহণ করে চালু করবে। তার পরে নানা জায়গায় চিঠি-চাপাটি দেওয়া হয়েছে। এত দিন পরে তিনি বলছেন, অধিগ্রহণ করার ক্ষেত্রে সরকারের কিছু অসুবিধা রয়েছে। তাই পিপিপি মডেলে কীভাবে করতে পারেন সেই চেষ্টা করছেন।” তাঁর প্রশ্ন, “এতদিন পরে আজ হঠাত্ তিনি সরকারি অধিগ্রহণের বদলে পিপিপি মডেলে করার কথা বললেন কেন? সেটা আমাদের কাছে পরিস্কার হয়নি। পিপিপি মডেল মানে তো সেই বেসরকারি কলেজ। লাখ টাকা খরচ করে এই জেলায় কে পড়তে আসবে। কলেজটি’র ভবিষ্যত্ তো ফের অন্ধকারেই চলে যাবে।”
পুরুলিয়ায় এই কলেজটি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৮০ সালে। আগে মেধাতালিকার ভিত্তিতে কোর্স ফি’র বিনিময়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তি হত। মণীন্দ্রনাথবাবু জানান, ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে রাজ্য সরকার জানিয়ে দেয় যে, জয়েন্টের মেধাতালিকার ভিত্তিতে ভর্তি করতে হবে। মোট ৫০টি আসনের মধ্যে ২৫টি ছিল ‘ফ্রি সিট’। বাকি ২৫টি ‘ডোনেশন সিট’। ফ্রি সিটের ক্ষেত্রে ২৫ হাজার টাকা কোর্স ফি এবং ডোনেশন সিটের ক্ষেত্রে কোর্স ফি ছিল ৭৫ হাজার টাকা। ওই বছর থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রী ভর্তি করতে পারেনি। রাজ্য সরকার এই নির্দেশ জারি করার পরে ওই শিক্ষাবর্ষে ১৬ জন, ২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষে ১৯ জন ও ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষে ৩ জন ছাত্র পাঠায়। পরের দু’টি শিক্ষাবর্ষে আর কোনও পড়ুয়া এখানে ভর্তি হতে আসেনি। নির্দেশ জারির পরে যেখানে আড়াইশো পড়ুয়া ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভর্তি হয় মাত্র ৩৮ জন। সব ছাত্রই ফ্রি সিটের। এর ফলে কলেজ মুখ থুবড়ে পড়ে। তার মধ্যে ২০০৮ সালের অগস্ট মাসে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীন ‘আয়ুষ’ কলেজে পঠন পাঠনের উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই এই কারণ দেখিয়ে কলেজে ছাত্র ভর্তি বন্ধ করে দেয়। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে কলেজের ৪৩ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর ভবিষ্যত্। এরপরে এই কলেজ বেসরকারি করে দিলে জঙ্গলমহলের দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে কি এত অর্থ দিয়ে এখানে পড়াশোনা করা সম্ভব হবে?
যদিও পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় সংস্থা ‘আয়ুষ’ই জানায় যে, রাজ্য সরকার যদি অনুমতি দেয় তা হলে কলেজ পুনরায় খোলার প্রশ্নে তাঁদের কোনও আপত্তি নেই। মণীন্দ্রনাথবাবু বলেন, “তবে কিছু শর্ত ছিল, সে ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারকে পরিকাঠামোর বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট দিতে হবে। পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্য পরিষ্কার ভাবেই জানায় যে, রাজ্য সরকার অধিগ্রহণ করলে তাদের কোনও আপত্তি নেই। আমরা রাজ্য সরকারকে অসংখ্য চিঠি লিখেছি। কলেজ সরেজমিনে পরিদর্শন করে গিয়েছেন রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের প্রতিনিধি। পাশাপাশি জঙ্গলমহলের বিধায়কেরাও মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন কলেজটি যাতে পুনরায় চালু করা যায়।” তিনি জানান, পিপিপি মডেলে ভারতবর্ষের কোথাও হোমিওপ্যাথি কলেজ নেই। দেশে মোট ১৭৬টি হোমিওপ্যাথি কলেজের মধ্যে কোনওটি সরকারি, কোনওটি বেসরকারি। কিন্তু কোথাও পিপিপি মডেলে কোথাও নেই। যে কারণে কলেজটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পুনরায় সেই কারণেই কলেজটি ফের বন্ধ হয়ে যাবে। তাঁর কথায়, “শিক্ষাকর্মীদের অবস্থা এমন যে, তাঁদের কেউ রিকশা টানছেন, কেউ বেসরকারি ছোট প্রতিষ্ঠানে কাজ করে কোনওরকমে দিন চালাচ্ছেন।”
কলেজের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য গঙ্গাধর মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের কাছে তো খবর ছিল, এই কলেজটি সরকারই অধিগ্রহণ করবে। এখন শুনছি পিপিপি মডেলে করবে। এই বদল কেন বুঝতে পারছি না!” এই কলেজটিকে সরকারি অধিগ্রহণের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসছে লোকসেবক সঙ্ঘ। সঙ্ঘের বর্তমান সচিব সুশীল মাহাতো বলেন, “অধিগ্রহণের কথা সরকারি সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী নিজে ঘোষণা করেছেন। তারপরে এখন উনি জানাচ্ছেন পিপিপি মডেলে করা হবে। উনি তো নিজের অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছেন।” সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে আজ বুধবার কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন পুরুলিয়ার বিধায়ক কেপি সিংহ দেও। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে গিয়েছেন। কলেজ কী অবস্থায় রয়েছে তা নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলব। তারপরে আয়ুসের মন্ত্রী কলেজ পরিদর্শনে আসবেন।” কিন্তু শিক্ষকেরা তো কলেজটিকে সরকারি অধিগ্রহণের দাবি তুলছেন? কেপি সিংহ দেও বলেন, “আগে তাঁদের সঙ্গে কথা বলি। তা ছাড়া মুখ্যমন্ত্রী তো বলেই গিয়েছেন খোলার চেষ্টা করছেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy