স্কুলে-স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের চোখ পরীক্ষা এবং চোখে সমস্যা পেলে দ্রুত তা ঠিক করার কাজে ডাহা ফেল করেছে কলকাতা। স্বাস্থ্য দফতরের সাম্প্রতিক রিপোর্টে সেই তথ্য প্রকাশের পরেই ব্যর্থতার দায় নিয়ে স্বাস্থ্যকর্তাদের সঙ্গে শিক্ষাকর্তাদের চাপান-উতোর শুরু হয়েছে। কিন্তু সুরাহার পথ বেরোয়নি।
চিকিৎসকদের মতে, ছাত্রছাত্রীদের চোখে পাওয়ার, এক চোখে কম দেখা বা অ্যাম্বলায়োপিয়া, চোখ ট্যারা হওয়া, চোখে ছানি পড়ার মতো নানা রকম সমস্যা দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে সে সব সময়মতো নির্ণয় হয় না। দেরি হলে চিরকালের মতো চোখে দৃষ্টি কমে যেতে পারে বা অস্বাভাবিক হারে পাওয়ার বেড়ে যেতে পারে। ছানির বা গ্লকোমার ঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে চিরকালের মতো দৃষ্টি নষ্টও হতে পারে।
শিশুদের চোখের সমস্যা দ্রুত চিহ্নিত করার জন্যই কলকাতা-সহ সব জেলায় স্কুলে-স্কুলে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের চোখ পরীক্ষার কর্মসূচি নেয় স্বাস্থ্য দফতর। ঠিক হয়েছিল প্রত্যেক স্কুলের কিছু শিক্ষককেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে যাতে তাঁরা নিজেদের স্কুলের ছাত্রদের চোখ পরীক্ষার কাজ করতে পারেন। কিন্তু ২০১২-১৩ সালের প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, কলকাতা এই ব্যাপারে অন্যান্য সব জেলা থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এমনকী, ২০১১-১২ সালের তুলনাতেও ২০১২-১৩ সালে ‘স্কুল আই স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম’-এ কলকাতার অবস্থা চোখে পড়ার মতো খারাপ হয়েছে।
রিপোর্ট অনুযায়ী, অন্যান্য জেলায় ২০১২-১৩ সালে কোথাও সাড়ে তিনশো, কোথায় সাড়ে পাঁচশো বা সাড়ে সাতশোর মতো স্কুলে গিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের চোখের ডাক্তার ও টেকনোলজিস্টরা ছাত্র-ছাত্রীদের চোখ পরীক্ষা করেছেন। সেখানে কলকাতায় সাকুল্যে ২৬টি স্কুলে যাওয়া হয়েছে। এর আগের বছরও কলকাতায় ৪৮টি স্কুলে যাওয়া হয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবে চোখে সমস্যা রয়েছে এমন ছাত্রছাত্রীও অনেক কম চিহ্নিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, কলকাতার কোনও স্কুলের কোনও শিক্ষককে চোখ পরীক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি! ফলে প্রশিক্ষিত চিকিৎসকেরাই স্বাস্থ্য দফতরের পরোয়া না করে ছাত্রছাত্রীদের চোখ পরীক্ষা করে নেবেন, সেটাও হয়নি।
কলকাতায় কেন এই অবস্থা?
স্বাস্থ্য দফতরের অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অধিকর্তা (চক্ষু) সিদ্ধার্থ নিয়োগী প্রথমে উত্তর দেন, “রিপোর্টে ভুল রয়েছে!” কিন্তু রিপোর্ট যে তাঁরাই তৈরি করেছেন, সে কথা মনে করানোয় তাঁর বক্তব্য, “আসলে কলকাতায় প্রয়োজনের তুুলনায় টেকনিশিয়ান বা অপ্টোমেট্রিস্ট কম। তার উপরে কলকাতার হাসপাতালে আউটডোরে রোগীর চাপও মারাত্মক। সেই সব সামলে ডাক্তার বা টেকনিশিয়ানেরা স্কুলে যাওয়ার সময় কম পান। জেলার হাসপাতালগুলিতে সাধারণত সপ্তাহে দু’বার চোখের আউটডোর হয়। ফলে ডাক্তারেরা সময় একটু বেশি পান। তবে কলকাতায় আমরা তাড়াতাড়ি লোক নিয়োগ করব।”
স্কুল আই স্ক্রিনিং-এর দায়িত্বে থাকা ‘রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজি’র এক কর্তা আবার জানান, কলকাতায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ক্রমশ বাড়ছে। সেখানে মূলত উচ্চমধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েরা পড়ে। সেখানকার স্কুল কর্তৃপক্ষ বা অভিভাবকেরা কেউ এই সরকারি পরীক্ষায় আগ্রহী বা বিশ্বাসী নন। তাদের দেওয়া চশমাও তারা নিতে চায় না। সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতেও অর্ধেক সময় হয় ছুটি না-হয় পরীক্ষা থাকে। মাত্র ৩-৪ মাস তারা খালি থাকে। ওইটুকু সময়ে বেশি স্কুলে যাওয়া যায় না।
শিক্ষকদের চোখ পরীক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া নিয়ে সিদ্ধার্থবাবুর বক্তব্য, “কলকাতার শিক্ষকেরা ক্লাস, খাতা দেখা আর টিউটোরিয়াল নিয়ে এত ব্যস্ত যে প্রশিক্ষণে আসতে চান না। এই অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতেই তাঁদের অনীহা।” এ ব্যাপারে সদ্য-প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “কলকাতায় এতটা খারাপ ফলের ব্যাপারটি আমাকে কেউ জানায়নি। আমি নতুন মন্ত্রীকে এটা জানাব। তিনি নিশ্চয়ই কিছু করবেন।” এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘সবে নতুন পদে এসেছি। এই বিষয়ে ভাল করে খোঁজখবর নিয়ে যা করণীয়, তা করব।”
স্কুল শিক্ষা কমিশনার রাজেশ সিংহ আবার সরাসরি জানালেন, এই রকম কোনও কার্যক্রমের কথাই তিনি শোনেননি। তবে শিক্ষা দফতরের অন্য এক কর্তার কথায়, “সমস্যাটা দুই দফতরের সমন্বয়ের অভাবের। স্বাস্থ্য দফতর যদি অভিযোগ করে, স্কুল কর্তৃপক্ষ বা শিক্ষকেরা এই কার্যক্রমে আগ্রহ দেখান না, তা হলে আমাদের প্রশ্ন হবে, স্বাস্থ্য দফতর আদৌ ক’টি স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে চোখ পরীক্ষা করতে চায় বা কোনও স্কুল প্রত্যাখ্যান করলে স্কুল শিক্ষা দফতরে সেটা জানায়?” চক্ষু বিভাগের কর্তারা এর কোনও জবাব দিতে চাননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy