প্রশাসনিক গাফিলতি আর অসচেতনতার মাসুল গুনছে জ্বরে জর্জর উত্তরবঙ্গ। কিন্তু তাকে দেখেও কলকাতা কোনও শিক্ষা নিল না! যাবতীয় জ্বরে রক্ত পরীক্ষার সরকারি ফরমান কার্যত শিকেয় তুলে রাখল!
উপসর্গ দেখেও দ্রুত রোগ নির্ণয়ে তৎপর না-হওয়ায় উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিস-পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়েছে। এ পর্যন্ত শ’দেড়েক মানুষ মারা গিয়েছেন। রোগ-জীবাণু চিহ্নিত না-হওয়ায় অনেকের এনসেফ্যালাইটিস-উপসর্গের সঠিক কারণ জানা যায়নি। এমতাবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) দ্রুত রোগ নির্ণয়ের সুপারিশ করেছে। তাই বছরের এই সময়টায় যে কোনও ধরনের জ্বরেই রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর।
অথচ খাস মহানগরের সরকারি হাসপাতালগুলিতে প্রায়শই সেই নির্দেশ মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ। এমনকী, এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীরও প্রয়োজনীয় রক্ত বা ফ্লুইড পরীক্ষা হচ্ছে না! যেখানে পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই, সেখানে তো নয়ই। আবার কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলোয় এ ধরনের পরীক্ষার পরিকাঠামো মজুত থাকা সত্ত্বেও তা কাজে লাগানোর তৎপরতা অনেক ক্ষেত্রেই গরহাজির। অভিযোগ, আপৎকালীন পরিস্থিতিতেও সব জায়গায় প্রয়োজনীয় কিট জোগাড় করে রাখা হচ্ছে না। নমুনা সোজা পাঠানো হচ্ছে ট্রপিক্যালের মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। স্বভাবতই দেরি হচ্ছে। ধরাই পড়ছে না, রোগটা কী।
যেমন ধরা পড়েনি প্রান্তিক রায়ের। বাঁশদ্রোণির দু’বছরের বাচ্চাটিকে শুক্রবার গভীর রাতে প্রবল জ্বর ও খিঁচুনির উপসর্গ নিয়ে এমআর বাঙুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বাঙুর তাকে রেফার করে দেয় ন্যাশনালে, যেখানে শনিবার ভোরে তার মৃত্যু হয়েছে। ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ হিসেবে শুধু লেখা হয়েছে ‘এনসেফ্যালাইটিস।’ কী ধরনের এনসেফ্যালাইটিস, তা বলা হয়নি। প্রশ্ন উঠতে জানা গেল, শিশুটির রক্ত পরীক্ষাই হয়নি!
এনসেফ্যালাইটিসের পূর্ণ উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও বাঙুর বা ন্যাশনাল কেউ প্রান্তিকের রক্ত বা সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড (সিএসএফ) পরীক্ষার মতো প্রাথমিক কাজটা করল না কেন, স্বাস্থ্যভবন এখন তার ব্যাখ্যা চেয়েছে। কারণ, এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ থাকলেই রক্ত ও সিএসএফ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। এতে জানা যায়, রোগীর শরীরে জাপানিজ এনসেফ্যালাইটিসেরভাইরাস রয়েছে কি না। বস্তুত উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ থাকা বহু রোগীর প্রাথমিক অবস্থায় রক্ত বা সিএসএফ, কোনওটাই পরীক্ষা করা হয়নি। হলে উত্তরবঙ্গে এত মানুষকে মরতে হতো না বলে আক্ষেপ শোনা গিয়েছে সংক্রামক রোগ সংক্রান্ত গবেষক-বিশেষজ্ঞদের মুখে। স্বাস্থ্য-কর্তাদের একাংশেরও প্রশ্ন, উত্তরবঙ্গে অনেক জায়গায় না হয় পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। কিন্তু খাস কলকাতার হাসপাতালেও একই ঘটনা হবে কেন? বিশেষত ন্যাশনালের মতো মেডিক্যাল কলেজে? যেখানে কিনা পরীক্ষার পরিকাঠামো বিলক্ষণ রয়েছে? এক স্বাস্থ্য-আধিকারিকের খেদ, “জ্বর হলেই রক্ত পরীক্ষা করান শহর জুড়ে বিশাল বিশাল এমন হোর্ডিং দিয়ে আদৌ কোনও লাভ হবে কি না, সেটাই সন্দেহ হচ্ছে।”
হাসপাতাল কেন প্রান্তিকের রক্ত বা সিএসএফ পরীক্ষা করল না?
কেউই অবশ্য পরিকাঠামোর অভাবের দোহাই দেয়নি। অন্য কথা বলেছে। বাঙুর-কর্তৃপক্ষের দাবি, শিশুটির শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। বাঙুরে যে হেতুু পেডিয়্যাট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট নেই, তাই তাঁরা দ্রুত ওকে ন্যাশনালে রেফার করেছিলেন। “পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গেলে অনেকটা সময় নষ্ট হতো।” বুধবার বলেন হাসপাতালের এক কর্তা। অন্য দিকে ন্যাশনালের সুপার পীতাম্বর চক্রবর্তীর ব্যাখ্যা, “বাচ্চাটার এত খিঁচুনি হচ্ছিল যে, ওর শরীর থেকে রক্ত বা ফ্লুইড নেওয়া যায়নি। তবে ক্লিনিক্যাল ডায়াগনসিস করে আমরা নিশ্চিত, ওটা এনসেফ্যালাইটিস। জাপানি এনসেফ্যালাটইটিস কি না, নিশ্চিত হতে পারিনি।” এ দিকে রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর দাবি, ওই সব উপসর্গ নিয়ে যারা কলকাতার হাসপাতালগুলোয় ভর্তি হচ্ছেন, সকলেই মেনিঙ্গো এনসেফ্যালাইটিসের রোগী। অধিকর্তার কথায়, “ওই ধরনের রোগী বছরভরই কোনও না কোনও হাসপাতালে ভর্তি থাকেন।”
কর্তাদের নিজস্ব দাবি বা মতামত থাকতেই পারে। কিন্তু নিয়ম তো নিয়মই! রক্ত-সিএসএফ পরীক্ষা ছাড়াই শুধু ‘ক্লিনিক্যাল ডায়গনিসিসের’ ভিত্তিতে মৃত্যুর কারণ ‘এনসেফ্যালাইটিস’ লিখে দেওয়া নিয়ে বিতর্ক তাই থেকেই যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, দিন কয়েক আগে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যালে একই উপসর্গে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট আসার আগেই ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ ‘মেনিঙ্গো এনলেফ্যালাইটিস’ লিখে দিয়েছিলেন। শোরগোল ওঠায় ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন স্বাস্থ্য-অধিকর্তা।
পাশাপাশি প্রশ্ন উঠছে, কলকাতার সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিজস্ব পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও সন্দেহজনক ক্ষেত্রে চটজলদি রক্ত ও ফ্লুইড পরীক্ষার ব্যবস্থা কেন হচ্ছে না? কেন উত্তরবঙ্গের হাল দেখেও হুঁশ ফিরছে না? যার জবাবে স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বলছেন, “এ ব্যাপারে অনেক আগেই নির্দেশ জারি হয়েছে। কোনও হাসপাতালেরই তা না-মানার কথা নয়। কেন ন্যাশনাল বা বাঙুরে ওই শিশুটির রক্ত পরীক্ষা হল না, তা জানাতে নির্দেশ দিয়েছি।”
হাসপাতালের ‘সরকারি’ ব্যাখ্যা কী হবে, তা সময়ই বলবে। তবে এই ধরনের পরিস্থিতিতে রোগ নির্ণয় প্রক্রিয়া যে রকম দ্রুততায় সেরে ফেলা জরুরি, অনেক ক্ষেত্রে তারও অভাব দেখা যাচ্ছে। কারণ, একই রকম উপসর্গ নিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একাধিক রোগী গত ক’সপ্তাহে ভর্তি হয়েছেন। এবং মেডিক্যাল-কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, ওঁদের রক্ত এবং ফ্লুইডের নুমনা তাঁরা স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে পাঠালেও সেখান থেকে তাঁদের জানানো হয়েছে, দু’সপ্তাহের আগে রিপোর্ট মিলবে না! “রোগ ধরতেই যদি এত সময় বেরিয়ে যায়, চিকিৎসাটা হবে কখন?” আক্ষেপ করছেন মেডিক্যালের ডাক্তারেরা। অন্য দিকে ট্রপিক্যাল কর্তৃপক্ষ লোকবলের অভাবের যুক্তি দিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য: তাঁরা যে ‘কিট’ ব্যবহার করেন, তাতে এক সঙ্গে ৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব। তাই নমুনা বেশি না-জমলে পরীক্ষা না-করাই দস্তুর। তাই কখনও-সখনও রিপোর্ট দিতে দেরির কথা বলা হয়। তবে এমন জরুরি পরিস্থিতিতে তা-ও হওয়ার কথা নয় বলে ট্রপিক্যালের তরফে জানানো হয়েছে।
স্বাস্থ্য-অধিকর্তাও জানিয়েছেন, এমনটা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মেডিক্যাল-কর্তৃপক্ষ কেন নমুনা ট্রপিক্যালে পাঠালেন? তাঁদের তো নিজস্ব ব্যবস্থা ছিল?
মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ তপনকুমার লাহিড়ির দাবি, সুচিকিৎসার স্বার্থেই তাঁদের এ হেন সিদ্ধান্ত। “ট্রপিক্যাল আমাদের একই ক্যাম্পাসে। ওদের ভাইরোলজি আমাদের চেয়ে উন্নত। তাই পাঠানো হয়েছে।” মন্তব্য তাঁর। এতে দেরি হবে না?
তপনবাবু বলেন, “সময় একটু লাগতে পারে। তবে পরীক্ষাটা তো ঠিকঠাক হবে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy