অর্থনীতি পড়ে সফল হতে গেলে এই বিষয়টার মতো করে ভাবতে হয়।
অর্থনীতি নিয়ে পড়লে দারুণ সব চাকরি পাওয়া যায়, নিশ্চয়ই শুনেছ। কী চাকরি, এই লেখায় সে কথা বলব না। আজ খোঁজ করব, অর্থনীতি পড়লে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কাদের বেশি। এটা এমন একটা বিষয়, যাকে ভালবাসতে না পারলে টিকে থাকা খুব কঠিন। কথাটা সব বিষয়ের জন্যই সত্যি, সেটা ঠিক, কিন্তু অর্থনীতির জন্য আরও বেশি সত্যি। তার সবচেয়ে বড় কারণ হল, অর্থনীতি পড়ে সফল হতে গেলে এই বিষয়টার মতো করে ভাবতে হয়। তোমার ভাবনা যদি অর্থনীতির ভাবনার খাত ধরে চলতে পারে, তা হলে দেখবে, এর থেকে বেশি মজা আর কোথাও নেই।
সেই সব কথায় যাওয়ার আগে একটা অন্য কথা বলি। আমরা যখন লেখাপড়া করেছি, তখন একটা জিনিস হত— এখনও ঠিক সেটাই হয়— অনেক ছেলেমেয়েই কী নিয়ে পড়বে ঠিক করতে না পেরে অর্থনীতি পড়তে চলে আসে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভাল জায়গায় চান্স না পেয়ে, অথবা হিউম্যানিটিজ় নিয়ে পড়ার ইচ্ছে থাকলেও লোকে কী বলবে, সেই ভয়ে অর্থনীতি পড়তে আসা একটু গোলমেলে সিদ্ধান্ত। অর্থনীতি পড়তে এসো বিষয়টা পড়বে বলেই, অন্য কিছু না পেয়ে বা না পড়ে নয়।
পড়বে তো, কিন্তু অর্থনীতি বিষয়টা কী? আমায় জিজ্ঞাসা করলে বলব, সূর্য-চন্দ্র বাদে দুনিয়ার সব কিছুই আসলে অর্থনীতির অঙ্গ। বিষয়টা সম্বন্ধে যদি খুঁটিয়ে জানতে চাও, তা হলে কয়েকটা বই পড়ে দেখতে পারো। অর্থনীতি ব্যাপারটা কী, সেটা আদৌ তোমার ভাল লাগছে কি না, নিজেই পরখ করে দেখতে পারবে। প্রথম বইটার নাম হল ইকনমিকস: আ ইউজ়ার্স গাইড। লেখক হা-জুন চ্যাং। এটা পড়লে বুঝতে পারবে, অর্থনীতি বলতে ঠিক কী বোঝায়। দ্বিতীয় বইটি হল, টকিং টু মাই ডটার অ্যাবাউট দ্য ইকনমি। লেখক ইয়ানিস ভারুফাকিস এক সময় গ্রিসের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। বইটি তাঁর কিশোরী মেয়ের বোঝার মতো করে লেখা, ফলে তোমরাও স্পষ্ট বুঝতে পারবে। তৃতীয় যে বইটার কথা বলব, তার নাম দ্য ওয়ার্ল্ডলি ফিলজ়ফার্স: দ্য লাইভস, টাইমস অ্যান্ড আইডিয়াজ় অব দ্য গ্রেট ইকনমিক থিঙ্কার্স। লেখক, রবার্ট এল হাইলব্রোনার। অর্থনীতি নামক বিষয়টি কী ভাবে গড়ে উঠল একের পর এক চিন্তকদের হাত ধরে, এই বই থেকে তার চমৎকার একটা ছবি পাবে। তিনটে বই-ই ইংরেজিতে, তা নিয়ে আপত্তি করছ? ইংরেজিতে পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে তো!
এ বার অর্থনীতির চিন্তার খাতটার কথা বলি। কলেজে অর্থনীতির অনার্স ক্লাস আরম্ভ হওয়ার পরই সবার আলাপ হয় হোমো ইকনমিকাস-এর সঙ্গে। হোমো স্যাপিয়েন্সের তুতো ভাই বলা যেতে পারে ভদ্রলোককে। হোমো ইকনমিকাস বা অর্থনৈতিক মানুষ ভারী স্বার্থপর— নিজের কিসে সবচেয়ে উপকার হয়, তা ছাড়া আর কিছু নিয়ে তিনি মাথা ঘামান না। তাঁর সব সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ যুক্তি মেনে চলে, আবেগ-টাবেগের কোনও ব্যাপার নেই। শুধু বর্তমান নয়, কোন সিদ্ধান্তের ফলে ভবিষ্যতে কতখানি লাভ বা ক্ষতি হবে, তিনি সেটাও জানেন। এবং, প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তিনি এই সব কথা মাথায় রাখতে পারেন। এটা এক ধরনের অ্যাবস্ট্রাকশন— এই অর্থনৈতিক মানুষের চোখ দিয়েই আমাদের অর্থনীতির যুক্তিগুলো বুঝতে হয়। মজাটা দেখো— অর্থনীতির যাবতীয় চিন্তাভাবনা মানুষকে নিয়ে, যে কোনও সমাজবিজ্ঞানের মতোই। কিন্তু ইতিহাস বা সমাজতত্ত্বে যেমন আসল মানুষদের নিয়ে কারবার, অর্থনীতিতে তা নয়। পদার্থবিদ্যায় যেমন একটা কল্পিত আদর্শ পরিস্থিতি ধরে নিয়ে তত্ত্ব তৈরি করা হয়, অর্থনীতিতেও তেমনই।
অর্থনীতি পড়তে এসে এই অ্যাবস্ট্রাকশন বা বিমূর্ততাতেই ধাক্কা খায় অনেক ছেলেমেয়ে। কিন্তু, ফিজ়িক্স তো আরও বেশি বিমূর্ত, কই তাতে তো কারও তেমন সমস্যা হয় না? এখানেই অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। পদার্থবিদ্যার কারবার যে সমস্ত বল নিয়ে, সেগুলো প্রকৃতিতে চিরন্তন বটে, কিন্তু আমাদের সাদা চোখে তা ধরা পড়ে না। অন্য দিকে, মানুষকে আমরা সর্ব ক্ষণ দেখছি— চারপাশে, এবং আয়নায়। সেই মানুষের ক্ষেত্রে একটি বিমূর্ত ধারণাকে সত্যি বলে মেনে নিতে সমস্যা হয় অনেকেরই। তার পর ধরো, অর্থনীতি পড়তে এলেই শুনতে হবে আর একটা কথা— সেটারিস প্যারিবুস। সংক্ষেপে, সেট পার। ল্যাটিন কথা, বাংলায় যার মানে, অন্য সব কিছু অপরিবর্তিত থাকবে। অর্থনীতির তত্ত্বের গোড়ায় আছে এই কথাটা— মানে, বাজারে যদি কমলালেবুর দাম বাড়ে, তা হলে শুধু তারই দাম বাড়বে, আর কিচ্ছুটির নয়। সেই দাম বাড়ার ফলে চাহিদা-জোগানের কী হেরফের হবে, অঙ্ক কষে বার করতে হবে সেটা। এ দিকে মনে হতেই পারে, শুধু কমলার দাম বাড়ছে, এ আবার হয় না কি! বাস্তবের সঙ্গে টেক্সট বইয়ের এই দ্বন্দ্বটাকে পেরিয়ে আসতে পারলেই দেখবে, বিষয়টা কী রকম ইন্টারেস্টিং।
ভয় পেয়ো না! এই ভাবে ভাবতে না পারলে অর্থনীতি পড়াই যাবে না, এমন কথা বলছি না মোটেই। পড়তে পড়তে এই ভাবনার চলন রপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু, যদি বাস্তবকে কেটেছেঁটে তার নির্যাসটুকু নিয়ে ভাবতে ভাল লাগে তোমার, তা হলে অর্থনীতি পড়াটাও তোমার কাছে অনেক এক্সাইটিং হবে। আসল কথাটা হল যুক্তির সঙ্গে সাবলীলতা। যত সহজে কোনও যুক্তিকে ধরে নিয়ে সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে, সেই যুক্তির ছক মেনে ভাবতে পারবে, অর্থনীতি পড়তে ততই সুবিধা হবে।
তার পরের কথা হল অঙ্ক। রামানুজনের মতো অঙ্ক কষতে হবে, এমন কোনও কথা নেই মোটেই। কিন্তু, অঙ্ক দেখলেই পালিয়ে গেলে চলবে না। অর্থনীতির যুক্তির প্রকাশের ভাষা হল অঙ্ক। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের অঙ্কে যদি অসুবিধা না থাকে, তা হলে স্নাতক স্তরে অর্থনীতির অঙ্ক কষতেও সমস্যা হবে না। কিন্তু মনে রেখো, অর্থনীতি পড়া মানেই অঙ্কের সঙ্গে ঘর করা।
এক দিকে বলছি যে কোনও সমাজবিজ্ঞানের মতোই অর্থনীতিরও কারবার মানুষকে নিয়ে, অথচ অন্য দিকে এক বার বলছি পদার্থবিদ্যার মতো বিমূর্ত ভাবনা চাই, আর এক বার বলছি অঙ্ক কষতে হবে অনেক— ভাবতেই পারো, ব্যাপারটা তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে? মানুষ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, এমনকি রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ থাকলে অর্থনীতি পড়া অনেক বেশি আনন্দের হয়। শুধু তা-ই নয়, ভবিষ্যতে গবেষণার কাজে যেতে চাইলেও এই আগ্রহ জরুরি। ইতিহাস পড়তে যদি ভাল লাগে; খবরের কাগজের পাতায় রোজ যে রকমারি ঘটনার কথা থাকে, তার মধ্যে যদি যোগসূত্র খুঁজে পাও; অথবা কেউ কোনও কাজ কেন করছে, সেটা নিয়ে যদি নিজের মনেই ভাবতে থাকো— তা হলে অর্থনীতি পড়তে এলে তোমার ভাল লাগবেই।
আর একটা কথা এখানেই বলে রাখি— অর্থনীতি পড়তে এলে প্রথম বছর দুয়েক যা শিখতে হবে, সেগুলো আসলে অর্থনীতির যন্ত্রপাতি চালনা। এক বার সেই যন্ত্র তোমার আয়ত্ত এসে গেলে দেখবে, দুনিয়ার সব প্রশ্নের উত্তরই তুমি অর্থনীতির যুক্তি ব্যবহার করে দিতে পারছ। অন্যরা যা দেখতে পায় না, সেই সব কথা স্পষ্ট হয়ে উঠছে তোমার চোখে।
তখন দেখবে, পৃথিবীটা আসলে অর্থনীতির নিয়ম মেনেই চলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy