কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে চাকরিজীবনে যোগদান— এ একটা বিরাট ধাপ প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর জীবনে। অনেকেই হয়তো কোনও কর্পোরেট সংস্থায় যোগ দেবে। কলেজে এত দিন যে ভাবে কাটিয়েছ, তার তুলনায় কর্পোরেট জীবন একেবারেই আলাদা। এই পরিবর্তন তোমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, আর তার জন্য তোমাদের নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। সমাজে আমরা যেমন কিছু নিয়ম-নীতি মেনে চলার চেষ্টা করি, ঠিক তেমনই অফিসেও কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। স্কুল-কলেজে বা বাড়িতে যা শিখি সে রকমই, সঙ্গে আরও কিছু। হয়তো এগুলো তোমাদের কেউ বলে দেবে না বা শুধরেও দেবে না। কিন্তু এগুলো মেনে চললে কাজের জায়গায় তোমার সুবিধেই হবে।
পোশাক-আশাক
কর্পোরেট অফিসে সাধারণত ফর্মাল ড্রেস পরাটাই রীতি। যদিও সময়ের সঙ্গে এই রীতি পালটেছে। অনেক অফিসেই সপ্তাহান্তে কর্মীরা ‘স্মার্ট ক্যাজুয়াল্স’ও পরতে পারেন। তা বলে গ্রাফিক টি পরে না যাওয়াই ভাল। স্মার্ট ক্যাজুয়াল হিসেবে চলতে পারে কলার দেওয়া ক্যাজুয়াল শার্ট, জিন্স, সঙ্গে মানানসই লোফার বা স্নিকার্স। যেহেতু গরমের দেশে থাকি, ফলে গায়ে হাল্কা বডি-স্প্রে বা ডিয়োডোর্যান্ট ব্যবহার করতেই হয়। তবে সেটা যেন বেশি উগ্র না হয়।
পরিচ্ছন্ন
নিজের কিউবিক্ল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করো। যে জিনিসগুলোর কোনও প্রয়োজন নেই, ডাস্টবিনে ফেলে দাও। কাগজপত্র ছড়িয়ে রেখো না। বিষয় অনুযায়ী দরকারি কাগজপত্রের ফাইল তৈরি করো, সেগুলো লেবেল করে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখো, দরকার মতো যাতে খুঁজে পাওয়া যায়। অনেকে ডেস্ক-এ সফ্ট টয়, সেলেব্রিটিদের পোস্টার, ক্যান্ডল স্ট্যান্ড সাজিয়ে রাখে। অফিস যেহেতু একটা প্রফেশনাল জায়গা, তাই এই সব জিনিস না রাখাই ভাল। ডেস্ক-এ রাখতে পারো টেবিল টপ ক্যালেন্ডার। সেখানেই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো মার্ক করে রাখো। চোখের সামনে থাকবে, ভুল হবে না। অনেক সময় কিছু না পেয়ে জরুরি তথ্য আমরা হাতের কাছে কোনও কাগজে লিখে রাখি। তার পর সেটা তুলতে ভুলে যাই। পরে দরকারে আর পাওয়া যায় না সেটা। তাই হাতের কাছে একটা নোটপ্যাড আর পেন রেখে দেবে।
আদবকায়দা
প্রত্যেকটা বেসরকারি সংস্থার নিজস্ব কাজের রীতি-নীতি থাকে। সংস্থার কর্মী হিসেবে সেগুলো তোমাকে যেমন বুঝতে হবে, তেমনই প্রতি দিন প্রত্যেকটা কাজের মধ্যে দিয়ে তার প্রমাণও দিতে হবে। যারা এটা মেনে চলতে পারে না, তারা হামেশাই সমস্যায় পড়ে। জোরে হাসি, আলটপকা কথাবার্তা, অফিসের কম্পিউটার থেকে অন্য চাকরি খোঁজা, কাজের মাঝে ঘুমনো, সহকর্মীদের নিয়ে অহেতুক চর্চা, কাজের সময় টানা হোয়াটস্অ্যাপ করা বা কম্পিউটারে গেম খেলা, বস-কে ধারেকাছে দেখলেই হুড়মুড়িয়ে কাজে ফেরা, কিউবিক্ল থেকে মুখ বাড়িয়ে কথা বলা, অন্যের কাজের সময় নিজের কোনও কাজের কথা বলা, কেউ ই-মেল লেখার সময় পিছন থেকে উঁকি মারা— এই ধরনের ব্যবহারে কর্তৃপক্ষ তোমার ওপর বিরক্ত হবেন, বিশ্বাসও হারাবেন।
অফিসে কেউ যদি তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন, তুমিও উলটে তাঁর সঙ্গে একই রকম আচরণ করো না। রাগ হলেও নিজেকে সংযত করো, নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে শেখো। দরকারে তাঁর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলার চেষ্টা করো। সহমর্মী হয়ে বোঝালে তাঁর আচরণে পরিবর্তন আসতেও পারে। যাঁরা অফিসের নানা বিভাগের দায়িত্ব সামলান, তাঁরা কিন্তু এমন লোকই চান, যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে পারে। যে যে পদেই থাকুন না কেন, সবার সঙ্গেই একই ভাবে মেশার চেষ্টা করো। অফিসে বেশ কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা একটা সবজান্তা, ওপরচালাক ভাব নিয়ে চলেন। তাঁদের অনুসরণ না করাই ভাল।
সকালে অফিসে এসে সবার সঙ্গে হাসিমুখে শুভেচ্ছা বিনিময় করো। যদি ঢুকেই আশপাশের কাউকে কিছু না বলে কাজ করতে বসে যাও, তা হলে তোমার সহকর্মীরা হয়তো মুখে কিছু বলবে না, কিন্তু তোমার সম্পর্কে তাদের ধারণাও খুব একটা ভাল হবে না। আবার ধরো, করিডরে এমন কারও সঙ্গে দেখা হল, যাঁর সঙ্গে আলাপ নেই, কিন্তু মুখ চেনো। এ ক্ষেত্রে চোখ ফিরিয়ে চলে যেও না। মৃদু হেসে মাথা নাড়ো। সহকর্মীরা বন্ধুসুলভ হলেও কিছু জিনিস মাথায় রাখতে হবে। যদি কখনও কারও কাছ থেকে স্টেপলার বা পেন নাও, সেটা বলে নিও। তার ডেস্ক-এ পড়ে আছে বলেই, না জিজ্ঞাসা করে তুলে নিও না। কাজ হয়ে গেলে সেটা মনে করে ফেরত দিও। তবেই তিনি ভবিষ্যতে তোমাকে কোনও জিনিস দিতে দ্বিধা করবেন না। অনেকে কোনও জিনিস নিয়ে ফেরত দেওয়ার সময় সেটা ছুঁড়ে ফেরত দেন। এই ধরনের আচরণ কর্পোরেট অফিসে একেবারেই
কাম্য নয়।
প্রশংসা করো
প্রশংসা সবাই ভালবাসেন। যখনই সহকর্মীর কোনও কাজ বা আচরণ প্রশংসনীয় বলে মনে হবে, মন খুলে তারিফ করো। তাতে অন্যেরাও তোমাকে পছন্দ করবেন। সেটা তোমার কাজের ক্ষেত্রেও সুবিধেজনক। তবে জোর করে কাউকে খুশি করার ভাবনা নিয়ে কারও বিষয়ে অকারণ ভাল কথা বোলো না। লোকে মেকি তারিফ ঠিকই ধরে ফেলে।
প্রয়োজনে ‘না’
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে তোমার মতের মিল না-ও হতে পারে। তখন কি চুপ করে থাকবে? সহকর্মীদের মধ্যে মতের অমিল কিন্তু খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। মার্জিত ভাবে, বুঝেশুনে ‘না’ বললে কেউই অসন্তুষ্ট হবেন না। ‘না’ বলার অনেক পদ্ধতি আছে। কোনও বিষয়ে তুমি সহমত নও, জানানোর আগে ‘কিছু মনে করবেন না’ বলে যুক্তি দিয়ে নিজের মত প্রকাশ করাই ভাল। তা ছাড়া ভিন্নমত প্রকাশ করার আগে ব্যাপারটা সম্পর্কে কোনও ইতিবাচক কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। এতে অন্যরা তোমার প্রতি কোনও নেতিবাচক মনোভাব রাখবেন না, বরং তোমার কথাকে গুরুত্ব দেবেন।
ভুল হলে
কাজে ভুল হতেই পারে। সেটা লুকনোর চেষ্টা কোরো না, বা কায়দা করে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিও না। বরং ‘আমার ভুল হয়েছে’ বলতে দ্বিধা কোরো না। ‘সরি’ বললে তুমি ছোট হয়ে যাবে না। তবে ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করো।
ফোন নিয়ে
সেলফোনে যখন কারও সঙ্গে কথা বলছ, যথাসম্ভব মৃদু স্বরে বলার চেষ্টা করো। অফিশিয়াল কল-এর ক্ষেত্রে সময় অনুযায়ী ‘গুড মর্নিং’, ‘গুড আফটারনুন’ বা ‘গুড ইভনিং’ দিয়ে কথা শুরু করো। একই সঙ্গে জেনে নাও, যার সঙ্গে তুমি কথা বলতে চাইছিলে তিনি সে-ই কিনা— ‘গুড আফটারনুন, অ্যাম আই স্পিকিং টু মিস্টার রায়?’ তিনি তখন ব্যস্ত কি না, জেনে নাও, তাঁকে কখন ফোন করা যাবে, সেটাও জিজ্ঞাসা করো। অহেতুক অপ্রয়োজনীয় কথা না বলে, যে বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইছ, সোজাসুজি সেই বিষয়ে চলে এসো। যত কম কথায় বিষয়টা সেরে ফেলতে পারো, তত ভাল। কী বলবে, সেটা ফোন করার আগে এক বার মনে মনেই গুছিয়ে নাও। যাতে বলার সময় অযথা কথা হাতড়াতে না হয়। অনেকেরই স্বভাব থাকে খুব তাড়াতাড়ি কথা বলার। ফোনে কিংবা সামনাসামনি, দু’টো ক্ষেত্রেই এটা যতটা পারো এড়ানোর চেষ্টা করো। ধীরে ধীরে, ভেঙে ভেঙে বলো, যাতে তিনি তোমার প্রতিটা শব্দ বুঝতে পারেন। বিশেষত ফোনে বিদেশের কারও সঙ্গে কথা বলতে হলে অবশ্যই এটা করতে হবে। কথা শেষ হয়ে গেলেই ফোন কেটে দিয়ো না। ‘গুডবাই’ না বলে ‘টেক কেয়ার’ বা ‘নাইস স্পিকিং উইথ ইউ’ বলে কথা শেষ করাটা অনেক ভাল। অনেকে খাওয়ার সময়েই কাজের ফোন করে। সেটা ঠিক না।
হয়তো নিজের কিউবিক্ল-এ কারও সঙ্গে কথা বলছ, সেই সময় কোনও ফোন এল। খুব জরুরি না হলে ধরো না। একই ভাবে কোনও মিটিং-এ থাকলেও ফোনটাকে সায়লেন্ট মোডে বা বন্ধই করে রাখো। খুব দরকার পড়লে, সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরো। বা, পরে ফোন করে জেনে নাও। ডিরেক্ট ফোন-ই করো, মিস্ড কল দিয়ো না। এতে অনেকেই বিরক্ত হন। আর এমনি সময়ে সাইলেন্ট বা ভাইব্রেশন মোড-এ রাখো যাতে অন্যদের অসুবিধে না হয়।
‘মেসেজ’ইং
সব সময় সবাইকে ফোন করা যায় না। কিন্তু মেসেজ বা ই-মেল অবশ্যই করা যায়। এসএমএস করার সময়েও সেটা যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত এবং সৌজন্যমূলক রাখো। ‘Good morning Mr. Ghosh’ দিয়ে শুরু করে, শেষ করো ‘Regards’ আর তার পর তোমার নাম দিয়ে। বিশেষত কোনও সিনিয়রকে মেসেজ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই এ ভাবে করা উচিত। মেসেজ পাওয়ার পর কেউ যদি তার প্রত্যুত্তর দেন, তা হলে নীরব থেকো না। খুব সংক্ষিপ্ত হলেও, তাঁকে আবার একটা মেসেজ পাঠিয়ো। এতে তিনি বুঝতে পারবেন, তুমি তাঁর মেসেজটা পেয়েছ। তোমার ভদ্রতাও ফুটে উঠবে।
যখন ই-মেল লিখছ, এই একই পদ্ধতি ব্যবহার করো। লেখার শুরুতে ‘ডিয়ার মিস্টার বিশ্বাস’ দিয়ে যেমন শুরু করবে, তেমনই শেষ করবে ‘রিগার্ডস’ বা ‘সিনসিয়ারলি’ দিয়ে। শেষে তোমার পুরো নাম, পদ, সংস্থার পুরো ঠিকানা এবং ফোন নম্বর যেটাতে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে, সেগুলো দিয়ো। এবং সব সময় নজর রেখো, লেখায় কোথাও যেন কোনও ব্যাকরণগত ভুল না থাকে। আর সাবজেক্ট বক্সে তোমার বক্তব্যের একটা আভাস যেন থাকে। পরে এই মেলটা খুঁজে পেতেও সুবিধে হবে।
ভিজিটিং কার্ড
কারও সঙ্গে দেখা করে প্রথমেই, বা কথার শেষে নিজের বিজনেস কার্ডটা বিনিময় করো। কার্ড কখনও বাঁ হাতে দেবে না। দু’হাতে ধরে দিও। মনে রাখবে, এই কার্ড হল তোমার এবং তোমার সংস্থার অ্যাডভার্টাইজ়ার। নেটওয়ার্কিং গড়ে তুলতে এই কার্ড খুবই কাজে লাগে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy