একা মেয়ে রক্ষা করে গোটা হেমতাবাদ।
একটুও বাড়িয়ে বলা নয়। করোনার ভয়ে সবাই যখন পিছিয়ে যাচ্ছেন, একা, একদম একা, এগিয়ে এসেছিলেন সেলিনা খাতুন। এলাকার সমস্ত করোনা-আক্রান্তকে তিনি একাই তাঁর অ্যাম্বুল্যান্সে করে নিয়ে গিয়েছেন চিকিৎসার জন্য। তার ‘খেসারত’ও দিতে হয়েছে। একা সেলিনাকে নয়, তাঁর গোটা পরিবারকে। ভয়াবহ সেই সময়টা কাটিয়ে এখন একটু স্বস্তি। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ফের ভাবাচ্ছে উত্তর দিনাজপুরের এই তরুণীকে।
বাবার বয়স ৮২। মায়েরও বয়স হয়েছে। ৮ ভাইবোন। তবে বাবা-মা-দিদি আর এক ভাইপোকে নিয়ে সেলিনার সংসার পাঁচ জনের। ২০১৮ সাল থেকে সংসারের স্টিয়ারিং তাঁর হাতে। অ্যাম্বুল্যান্সের স্টিয়ারিংও। দিনদুপুর তো বটেই রাতবিরেতেও হেমতাবাদের একমাত্র ভরসা সেই সেলিনা। সেলিনা খাতুন। গোটা করোনা-কাল একমাত্র তিনিই অ্যাম্বুল্যান্সে করে হেমতাবাদের আক্রান্তদের নিয়ে গিয়েছেন জেলাসদরে— করোনা হাসপাতাল থেকে আইসোলেশন সেন্টার। সুস্থ হওয়ার পর সেলিনার অ্যাম্বুল্যান্সেই তাঁরা ফিরে এসেছেন নিজেদের গ্রামে। তবে ৭ জনকে ফিরিয়ে আনতে পারেননি তিনি। সে খেদ এখনও রয়েছে তিরিশ পেরনো তরুণীর।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ঠিকানা বাড়ি থেকে ২ কিলোমিটার দূরের হেমতাবাদ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সেখানেই তিনি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের যাত্রী প্রতীক্ষালয়ের একটা ঘরে দিদিকে নিয়ে থাকেন। দিনের বেলা একাই অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে এ হাসপাতাল ওই নার্সিংহোম করে বেড়ান। রাত্রিবেলায় কোথাও যেতে হলে চালকের পাশের আসনে সওয়ার হন তাঁর দিদি। করোনা-কালের শুরুর দিকে যখন রোগী নিয়ে কোনও অ্যাম্বুল্যান্স চালক যেতে রাজি হচ্ছিলেন না, তখন সে দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এসেছিলেন একা সেলিনা। তিনি করোনা-রোগীদের নিয়ে যান বলে, তাঁর গ্রামের বাড়ি ঘিরে দেওয়া হয়েছিল বাঁশ দিয়ে। বাইরে বেরোতে দেওয়া হত না পরিবারের কাউকে। তখনই জেলা স্বাস্থ্য দফতর তাঁকে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে থাকার অনুমতি দেয়।
দিনদুপুর তো বটেই রাতবিরেতেও হেমতাবাদের একমাত্র ভরসা সেই সেলিনা।
সেই থেকে এখনও এটাই সেলিনার ঠিকানা। বছরখানেক আগের সেই স্মৃতি এখনও টাটকা। সেলিনা বলছিলেন, ‘‘মানুষের মনে এত ভয় ছিল, আমি অ্যাম্বুল্যান্স চালাই বলে আমার বাজান (বাবা)-কে মসজিদে নমাজ পড়তে যেতেও বারণ করে দেওয়া হয়েছিল। মুদির দোকানে আমাদের জিনিসপত্র দিত না। ভয় তো ছিলই। সত্যিটাকে তো আর উপেক্ষা করা যায় না। তবে গ্রামে একটা ভুল ধারণা ছিল। আমি কিন্তু কখনও ওই সময় বাড়ি যাইনি। বা বাড়ির কেউও সেই সময় আমার সঙ্গে দেখা করত না।’’
রায়গঞ্জ কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক সেলিনা। বর্তমানে রবীন্দ্রভারতীর দূরশিক্ষার পাঠক্রমে তিনি স্নাতকোত্তর পড়ছেন বাংলা নিয়েই। পড়াশোনার পাশাপাশি চলছে তাঁর অ্যাম্বুল্যান্স চালানো। দাদা-ভাইরা যখন একে একে আলাদা হয়ে যাচ্ছেন, সেই সময় সংসার চলত তাঁর দিদির উপার্জনে। তিনি টেলারিংয়ের কাজ করতেন। সেলিনাও তাঁকে সাহায্য করতেন। কিন্তু আচমকাই দিদির চোখের সমস্যা দেখা দেয়। সংসারের সব দায়িত্ব এসে পড়ে সেলিনার কাঁধে। সেটা ২০১৮। স্থানীয় একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে তিনি রাজ্য সরকারি প্রকল্প ‘আনন্দধারা’য় গাড়ি চালানো শেখেন। ওই বছরেরই ২৭ জুলাই নিজেদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর অ্যাম্বুল্যান্স চালানোর দায়িত্ব নেন সেলিনা। যে টাকার ভাড়া হবে, তার ৪০ শতাংশ দিতে হয় ওই গোষ্ঠীকে। বাকি ৬০ শতাংশ দিয়ে গাড়ির তেল, রক্ষণাবেক্ষণ এবং সেলিনার পারিশ্রমিক। মাস গেলে হাতে যা থাকে, তা দিয়ে কোনও মতে চলে যায় সংসার।
গোটা করোনা-কাল একমাত্র সেলিনাই অ্যাম্বুল্যান্সে করে হেমতাবাদের আক্রান্তদের নিয়ে গিয়েছেন জেলাসদরে।
এ দেশেরই দক্ষিণ ভাগে সেলিনারই সমবয়সি এক তরুণী দেশের প্রথম মহিলা অ্যাম্বুল্যান্স চালকের স্বীকৃতি পেয়েছেন। গত বছরের অগস্টে তামিলনাড়ু সরকার এম বীরলক্ষ্মীর হাতে সরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের চাবি তুলে দিয়েছিল। নাম না শুনলেও সেলিনারও ইচ্ছে তেমনই। একটি স্থায়ী চাকরি। প্রাইমারি শিক্ষকের জন্য দু’বার পরীক্ষা দিয়েছেন। আইসিডিএস-এর জন্য পরীক্ষায় বসেছেন। সফল হতে পারেননি। এ বার স্বাস্থ্যকেন্দ্রের গাড়িচালকের পদে পরীক্ষা দিয়েছেন। সে পরীক্ষার ফল এখনও প্রকাশিত হয়নি। সেলিনার আশা, ওই ফল বেরোলেই তাঁর ইচ্ছেপূরণ হবে।
একটা স্থায়ী কাজ না পাওয়া পর্যন্ত বিয়ে করার কথা ভাবছেন না তিরিশ পেরোনো সেলিনা। স্বাবলম্বনের এই মনের জোরটাই বোধহয় সেলিনাদের আলাদা করে দেয় সাধারণের থেকে। আত্ম-অবলম্বনের এমন অ-সাধারণ চেতনাই তো অবলম্বন দিতে পারে অন্যকে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy