গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
দেওয়ালে লাগানো ছোট্ট একটা বোর্ড। সেখানে বড় করে লেখা ‘টিয়ার্স’। চোখের জল। সেটাই মোছাতে চান গীতা। গীতা রাউত। শিক্ষা দিয়ে, উত্সাহ দিয়ে, জীবনবোধ বদলিয়ে একদল কচিকাঁচার মুখে হাসি ফিরিয়ে আনার লড়াই। সামনেই শিক্ষক দিবস। গীতার জীবনে সে দিবসের কোনও বালাই নেই। বছর চল্লিশের গীতা ওই বাচ্চাদের কাছে ‘গীতা দিদিমণি’ বা ’গীতা ম্যাম’ নন, তিনি ওদের ‘গীতা মা’। গীতার মাতৃস্নেহেই একদল ‘রাস্তার ছেলেমেয়ে’ আজ সমাজের মূল স্রোতে ফিরেছে। ফেরার স্বপ্ন দেখছে আরও অনেকে।
গীতা থাকেন উত্তরপাড়ায়। আর তাঁর সন্তানেরা থাকে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। স্টেশনের উল্টো দিকে একটা হোটেল। গঙ্গাপাড়ে। তার উপরেই ‘টিয়ার্স’-এর ঘর। ঘরের বাইরে টাঙানো ছোট্ট বোর্ড। সেখানে যারা আসে তাদের বয়স কারও পাঁচ, কারও ছয়, কারও ১০, কারও ১৫। সবচেয়ে যে বড়, সে ১৭ বছরের। ওরা থাকে হাওড়া প্ল্যাটফর্মেরই বিভিন্ন জায়গায়। বাবা-মায়েরা নানা কাজ করেন। ওদের দিয়েও নানাবিধ কাজ করান। তার মধ্যে ভিক্ষাও রয়েছে। টাকাপয়সা না আনলে বাচ্চাদের খাওয়াদাওয়া বন্ধ, এমনও হয়! এমনই ৫০ জন শিশু-কিশোর ‘টিয়ার্স’-এ এই মুহূর্তে শিক্ষা পেতে আসে। শুধু শিক্ষা নয়, গীতা ওদের খাওয়াদাওয়ার ভারও কিছুটা নিয়েছেন। এর আগেও অনেক শিশু-কিশোরকে এই প্ল্যাটফর্ম থেকে তুলে নিয়ে গিয়েই লিলুয়া, বালি, উত্তরপাড়ার বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। তাদের বাবা-মাকেও প্ল্যাটফর্মের জীবন থেকে ওই সব এলাকার বিভিন্ন কাজে ঢুকে পড়ার উৎসাহ দিয়েছেন। তাঁদের জীবনে হাসি এনে দিয়েছেন অন্য রকমের।
প্রায় ৫০ জন শিশু-কিশোর ‘টিয়ার্স’-এ এই মুহূর্তে শিক্ষা পেতে আসে। নিজস্ব চিত্র।
উত্তরপাড়ায় শালিমার ফ্যাক্টরির কাছে থাকেন গীতা। শোনাচ্ছিলেন তাঁর পুরনো কথা। সেটা ছিল ২০০০ সালের কিছু আগের সময়। ট্রেনে করে গীতা স্কুলে যেতেন। রিষড়া বিদ্যাপীঠ। ট্রেনে দেখতেন, কত বাচ্চা ভিক্ষা করছে। কেউ জুতো পালিশ করছে। কেউ বা জলের বোতল কুড়োচ্ছে। দেখে খুব কষ্ট হত। নিজের টিফিনের ভাগ দিতেন ওদের। হাতখরচের অল্প পয়সা, সেটাও দিতেন। আর তখন থেকেই জীবনের সংকল্প ছিল, ওদেরকে জীবনের মূল স্রোতে ফেরাতে হবে। বাবা কাজ করতেন হিন্দমোটরে। সেই সূত্রেই উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর থেকে গীতাদের বাংলায় আসা। আর ফিরে যাননি। স্কুলজীবন উত্তরপাড়া-রিষড়ায় হলেও গীতার কলেজ জীবন অবশ্য গোরক্ষপুরেই। সেই জীবন কাটিয়েই গীতা ফের উত্তরপাড়ায়। তার পর থেকেই ওই শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু।
গীতা বিয়ে করেননি। কিন্তু এই বাচ্চাদের নিয়ে তাঁর ভরা সংসার। এই সংসার নিয়েই খুশি তিনি। নিজস্ব চিত্র।
প্রথম কর্মক্ষেত্র হাওড়া স্টেশনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম। একে একে ওই বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলা। তার পর তাদের বাবা-মায়েদের সঙ্গে সাক্ষাৎ। নানা বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে একটা ছোট পাঠশালা খোলেন। ধীরে ধীরে সেখানে বাচ্চার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর পরেই আসল ‘যুদ্ধ’। ওই বাচ্চাদের বাবা-মাকে বুঝিয়ে কাছাকাছির বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি করার কাজ করেন গীতা। অনেক বাবা-মা রাজিই হননি সেই সময়। আস্তে আস্তে তাঁদেরও জীবনের পাঠ দিতে থাকেন গীতা। শেষমেশ প্রথম যুদ্ধ জয়। ওই বাবা-মায়েদের অনেকেই লিলুয়া, বালি, উত্তরপাড়ার বিভিন্ন ভাড়াবাড়িতে উঠে যান, হাওড়া প্ল্যাটফর্মের বাস ছেড়ে। ওই সব এলাকাতে তাঁরা ছোটখাটো কাজও জুটিয়ে নেন। গীতার আজও মনে পড়ে বাবুসোনা, সঞ্জু, মনু, দিলীপদের কথা। হাওড়া প্ল্যাটফর্মে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করত। আর ডেনড্রাইয়ের নেশা। অনেক কষ্টে ওদের বুঝিয়ে নেশা ছাড়ানো। পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনা। ওই বাচ্চাদের অনেকেই এখন জীবনে প্রতিষ্ঠিত। আর সেটাই জেদ আর ইচ্ছে বাড়িয়ে দেয় গীতার। এর পর আর পিছন ফিরে তাকাননি।
ছোটবেলায় মা মারা গিয়েছেন তাঁর। গীতা বলছিলেন, ‘‘মা যখন মারা যান, আমি তখন খুব ছোট। বাবা খুব যত্নে আমাদের চার ভাইবোনকে মানুষ করেছেন। কিন্তু স্কুল যাওয়ার পথে ওই বাচ্চাদের দেখতাম, কী উদাসীনতায় বড় হচ্ছে। তখন থেকেই ঠিক করেছিলাম, ওদেরকে জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনব। ওদের মুখে জীবনের হাসিটা ফিরিয়ে আনব।
ভাইয়ের মিনারেল ওয়াটারের ব্যবসা। আয়ের কিছুটা ভাগ পান গীতাও। সেই টাকাতেই ওই বাচ্চাদের জীবনের শিক্ষা দেন। অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীও আছেন। তাঁদের অন্যতম কিশোর জয়সওয়াল। ‘টিয়ার্স’ যে বাড়িতে, সেটা কিশোরের। বিনা ভাড়ায় ওই ঘর তিনি গীতাকে তাঁর কাজের জন্য দিয়েছেন। এমনকি নীচের হোটেলে ওদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও। গীতা নিজে চাল-ডাল-তরকারি জোগাড় করার চেষ্টা করেন। অনেকেই তাঁর কাজের কথা জানেন। তাঁরাই সাহায্য করেন গীতার এই কাজে।
গীতা বিয়ে করেননি। কিন্তু এই বাচ্চাদের নিয়ে তাঁর ভরা সংসার। এই সংসার নিয়েই খুশি তিনি। ইচ্ছে আছে একটা আশ্রম বানানোর। সেখানে বৃদ্ধরাও যেমন থাকবেন, তেমনই থাকবে অনাথ শিশুরা। আরও বৃহৎ সংসার তৈরির ইচ্ছেটা মাথায় নিয়েই কাজ করে চলেছেন ‘গীতা মা’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy