ঝড়খালির সুকুমার সানা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
জল। ভাটি। জোয়ার। জঙ্গল। সুন্দরী। গরান। গেঁওয়া। বাঘ। বনবিবি। এ সব নিয়ে সুন্দরবন। তার মধ্যেই লক্ষ লক্ষ মানুষের বাস। কিন্তু সুন্দরের গহনে সেই বেঁচে থাকাই মাঝে মাঝে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। প্রকৃতির রোষে। বিপর্যয় শেষে সব কিছু আর স্বাভাবিক হয়ে ওঠে না আগের মতো। তবু বর্তে যাওয়ার জন্যই বারংবারের লড়াই।সেই লড়াই করতে করতেই ঝড়খালির সুকুমার সানা হয়ে উঠেছেন ‘কোকোনাট ম্যান’। বিদ্যাধরী নদীর দু’পাশে ম্যানগ্রোভের সঙ্গে নারকেল আর তালগাছের চারা পুঁতেই দিন কাটে সুকুমারের। লক্ষ্য, বাজ পড়ার হাত থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা আর নদী-ভাঙন ঠেকানো। উদ্দেশ্য, জোয়ার-ভাটির এ চরাচর বাঁচিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে রাখা।
বাঁ পা-টা নেই। অন্যের জমিতে চাষ করেন। নিজেরও বিঘেখানেক জমি আছে। সেখানেও হাত লাগান মাঝে মাঝে। ২০০০ সালে চাষের কাজ করতে গিয়ে হ্যান্ড ট্র্যাক্টর উল্টে পড়ে পায়ের উপর। তখনও বাসন্তী সেতু হয়নি। ফলে স্থানীয় নার্সিংহোমই ভরসা। পাঁচ দিনের মধ্যেই পায়ে পচন ধরে। তার পর অনেক কষ্ট করে কলকাতার সরকারি হাসপাতাল। সেখানে বাঁ পা কেটে বাদই দিতে হয়। কিন্তু প্রাণে বেঁচে যান সুকুমার। তখন থেকেই সঙ্গী ক্রাচ। সুকুমার বলছেন, ‘‘আমার ওই দুর্ঘটনার পর ডাক্তাররা অনেক কষ্ট করে আমাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। সে যাত্রা তো বেঁচে ফেরার কথা নয়। শরীরে পচন ধরে গিয়েছিল।’’ নিজের জীবন-গল্প শোনানোর মধ্যেই সুন্দবনকে জুড়ে দেন তিনি। বলেন, ‘‘ডাক্তাররা তো আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন। কিন্তু সুন্দরবনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই বেঁচে থাকার জন্য বড় অন্তরায়। তাই নিজেরাই চেষ্টা করছি। পরিবেশের তো আর আলাদা করে কোনও ডাক্তার হয় না।’’
কোনও জায়গায় গাছের সংখ্যা কমছে দেখলেই সুকুমার নিজের হাতে সেখানে বসিয়ে দেন নারকেল, তাল এবং বিভিন্ন ম্যানগ্রোভের চারা। —নিজস্ব চিত্র।
ক্যানিং মহকুমার ঝড়খালির ২ নম্বর লস্করপুরের বাসিন্দা সুকুমার। পেশায় কৃষক। স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে তাঁর ছোট্ট সংসার। ছেলে হরিদাস এ বারই ৪৩৫ পেয়ে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করেছে। স্ত্রী কৌশল্যাও তাঁর কাজের সঙ্গে আছেন। কী কাজ? গ্রামে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুরনো নারকেল বা তালের আঁটি চেয়ে নেওয়া। তার পর কারও জমিতে সেই নারকেল-তালের আঁটি ফেলে রাখা। চারা বেরোলেই বিদ্যাধরীর পাড়ে পুঁতে দেওয়া। সেই ২০০৫ সাল থেকে এটাই করছেন সুকুমার। ইদানীং ঝড়খালির পঞ্চায়েত-প্রধান একফালি জমি দিয়েছেন। সেখানেই ছোটখাটো ‘নার্সারি’ করেছেন সুকুমাররা। বহুবচন, কারণ, সুকুমারের সঙ্গে প্রায় ১০০ মহিলা রয়েছেন। তাঁর গ্রামেরই। এঁরা সকলেই বাড়ির কাজ সেরে গাছ লাগান নদী পাড় বরাবর। সুকুমারের স্ত্রী কৌশল্যাও ঝড়খালির সবুজ বাহিনীতে রয়েছেন। এটাই সুকুমারের দলের নাম।
এখন মূলত লোকের জমিতেই চাষ করেন। কিন্তু সুকুমারের মন পড়ে থাকে নদীর পাড়ে। সবুজ বাহিনী কী কী করল, তা-ই মাথায় ঘোরে সব সময়। তাঁর কথায়, ‘‘আমি আসলে মন থেকে এটা করি। না করলে আগামী প্রজন্ম এখানে বসবাস করতে পারবে না। এক একটা দুর্যোগ আসে আর আমাদের শেষ করে দিয়ে চলে যায়। মাথা তুলতে না-তুলতেই আবার একটা। শেষ হয়ে যাব। একমাত্র গাছই পারে আমাদের বাঁচাতে।’’ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে একপ্রস্ত ক্ষতি হয়েছে। সুকুমার বলছেন, ‘‘ইয়াসে তো যা হওয়ার হয়েইছে। তা এখনও সারিয়ে উঠতে পারিনি। এই যে নিম্নচাপের বৃষ্টি, তাতেও সব ধানগাছ মাটিতে শুয়ে পড়েছে। না দেখলে কল্পনা করা যাবে না।’’ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপকূল ও নদীর বাঁধ লাগোয়া এলাকা। এ সবের থেকে বাঁচার একমাত্র রাস্তা গাছ। এমনটাই মনে করেন সুকুমার। ভাঙন ঠেকাতে নদীপাড়ের ফাঁকা জায়গায় গাছ লাগান তিনি। ইতিমধ্যেই বিদ্যাধরী নদীর পশ্চিম পাড়ে প্রায় হাজার চারেক গাছ লাগিয়েছেন সুকুমাররা। কোনও জায়গায় গাছের সংখ্যা কমছে দেখলেই নিজের হাতে সেখানে বসিয়ে দেন নারকেল, তাল এবং বিভিন্ন ম্যানগ্রোভের চারা।
ক্রাচে ভর দিয়েই চলছে বন বাঁচানোর যুদ্ধ। —নিজস্ব চিত্র।
নদীর পাড়ে নারকেলের চারা পোঁতেন বলে স্থানীয়রা তাঁকে ‘কোকোনাট ম্যান’ বলেই ডাকেন। কেন নারকেল? সুকুমার বলছেন, ‘‘নদী উপকূল জুড়ে নারকেল গাছ লাগালে ভূমিক্ষয় আটকানো সম্ভব। পাশাপাশি বজ্রপাতের সময়ও নদী-সংলগ্ন এলাকাও রক্ষা পাবে। পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বেশির ভাগ সময়ে বাজ পড়ে নারকেল আর তালগাছে। বৈজ্ঞানিকরাও বলেন শুনেছি, নারকেল বা তালের মতো বড় গাছ থাকলে বাজ পড়ার হাত থেকে বাঁচা যায়। তাই নদীর পাড় বরাবরই গাছ লাগাচ্ছি। নারকেল-তালের পাশাপাশি বিভিন্ন ম্যানগ্রোভের চারাও লাগাই।’’ এর পর একটু হেসে তিনি বললেন, ‘‘সে কারণেই অনেকে আমাকে কোকোনাট ম্যান বলে ডাকে।’’
‘তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে...’। বছর পঁয়তাল্লিশের সুকুমারও। এক পায়ে দাঁড়িয়ে। ক্রাচে ভর দিয়েই চলছে তাঁর বন বাঁচানোর যুদ্ধ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy