দলের ভরাডুবির পর রাজ্যে রাজ্যে আক্রমণের মুখে রাহুল গাঁধী!
লোকসভায় গোহারা হওয়ার পর গত শনিবার সংসদীয় দলের বৈঠকে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী দলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, হারের কারণ নিয়ে ময়না-তদন্তের নামে পারস্পরিক দোষারোপ ও ঝগড়া বন্ধ করতে হবে। কিন্তু লোকসভায় মাত্র ৪৪টি আসনে নেমে যাওয়া কংগ্রেসের অবস্থা এখন এতটাই শোচনীয় যে নেত্রীর নির্দেশ মানা তো দূর, ঘুরে ফিরে নিশানা হচ্ছেন তাঁর ছেলেই।
গত দু’দিন যার নমুনা দেখা গিয়েছে কেরলে। আজ রাজস্থানেও সেই বিদ্রোহের চিত্রনাট্য। রাহুলের বিরুদ্ধে সরব দলের রাজ্য স্তরের ছোট, বড়, মাঝারি মাপের নেতারা। কংগ্রেসের বিধায়ক তথা প্রদেশ কংগ্রেসের নেতা ভঁবরলাল শর্মা এ দিন শুধু রাহুল নন, সরব হয়েছেন প্রিয়ঙ্কার বিরুদ্ধেও। জানিয়েছেন, সময় এসেছে রাহুল-প্রিয়ঙ্কার বাইরে গিয়ে কংগ্রেসকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার। রাহুলের তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, “বিশেষ একটি পরিবারের সদস্য হিসেবে সব রকম কর্তৃত্ব উপভোগ করছেন রাহুল। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাঁকে দলে ঢুকতে হয়নি।” ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদী যে ভাবে গাঁধী পরিবারকে আক্রমণ করে এসেছেন, এখন একই রকম তীব্র আক্রমণ আসছে কংগ্রেসেরই নেতাদের কাছ থেকে। সংবাদসংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাজস্থানের ওই বিধায়ক চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করেন দলের পরিবারতন্ত্রকে। দলে যাঁরা ‘প্রিয়ঙ্কা লাও রাহুল লাও’ স্লোগান তোলেন, তাঁদের উদ্দেশে ভঁবরলালের পরামর্শ, অন্য প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতাদের সামনের সারিতে নিয়ে আসার কথা ভাবা উচিত এখন। একা ভঁবরলাল নন, রাজ্য কংগ্রেসের অনেক নেতা এবং কর্মীও সহমত তাঁর সঙ্গে। দলে রাহুল ও অন্য নেতাদের অবস্থানের তফাত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শ্লেষ মিশিয়ে ভঁবরলাল বলেন, “রাহুল হলেন প্যারাস্যুটে নামা নেতা। তাই তাঁর সঙ্গে নীচের তলার নেতাদের সংঘাত অনিবার্য।”
দলের তরফে অবশ্য বলা হচ্ছে, এই ভঁবরলালের কথার কোনও গুরুত্বই নেই। লোকসভা ভোটে নিজের মেয়ে টিকিট না-পাওয়ায় মাসখানেক ধরেই তিনি বিক্ষুব্ধ রাজনীতি করছেন। এই ব্রাহ্মণ নেতা ইতিমধ্যেই বিজেপি নেত্রী বসুন্ধরা রাজের কাছে গিয়ে কথা বলে এসেছেন। এআইসিসি-র এক নেতা এমনও বললেন, “উনি দল থেকে বেরিয়ে বিজেপির সঙ্গে সমঝোতা করতে চান। তাই সমানে রাহুল-নিন্দা চালিয়ে যাচ্ছেন।” কংগ্রেস সূত্রের খবর, ভোটের ফল বেরোনোর আগে থেকেই রাহুল সম্পর্কে বিষোদ্গার করেছিলেন এই ভঁবরলাল। এ বার তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দু’দিন আগেই কেরলের কংগ্রেস নেতা টি এইচ মুস্তাফা রাহুলকে ‘ভাঁড়’ আখ্যা দিয়ে তাঁকে দলের সমস্ত পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তাঁকে দল থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ভঁবরলাল বা মুস্তাফার মতো রাজ্য স্তরের সামনের সারির নেতা রাহুল সম্পর্কে এমন মন্তব্য করছেন, এটা এক মাস আগে ভাবাই যেত না। এটা স্পষ্ট যে দলের অন্দরের এই রাহুল-বিরোধী বিক্ষোভ এ ভাবে প্রকাশ্যে চলে আসাটা কংগ্রেসের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠছে।
কেরলের মুখ্যমন্ত্রী উমেন চান্ডি, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কে ভি টমাস, কেরলের প্রদেশ সভাপতি ভি এম সুধীরন, প্রবীণ নেতা পি সি চাকোর উপস্থিতিতে বৃহস্পতিবার একটি প্রস্তাব পাশ হয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে। তাতে বলা হয়, কংগ্রেস যথার্থ শক্তিশালী এক জন নেতাকে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় স্তরেও আকর্ষণীয় প্রচার করা হয়নি। পরের দিনই অবশ্য ওই প্রস্তাব বদলে দিয়ে করে ক্ষত মেরামতের চেষ্টা করা হয়। নয়া প্রস্তাবে সনিয়া-রাহুলের ‘সাহসী নেতৃত্বের’ প্রশংসাই করা হয়েছে।
তবে এমন নয় যে ভোটে ভরাডুবির পরেই দলে তোপের মুখে পড়ছেন রাহুল। ভোট-পর্বেই, এমনকী তার আগেও রাহুলের নেতৃত্ব, কর্মপন্থা ও তাঁর পরামর্শদাতাদের নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিলেন দলের এক ঝাঁক নবীন ও প্রবীণ নেতা। ভোটে ধরাশায়ী হওয়া মিলিন্দ দেওরা, প্রিয়া দত্ত, সত্যব্রত চর্তুবেদীর মতো নেতারা খোলাখুলিই টিম-রাহুল অর্থাৎ মধুসূদন মিস্ত্রি, কনিষ্ক সিংহ, জয়রাম রমেশদের মতো নেতাদের সমালোচনায় মুখ খুলতে থাকেন একে একে। সেই ক্ষোভের আঁচ এখন আকবর রোডের দলীয় সদর কার্যালয় থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন রাজ্যের প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের মধ্যেও। কোণঠাসা রাহুল চাপের মুখেও পাল্টা চেষ্টা করছেন নিজের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধারের। তাঁরই ‘টিম’-এর অন্যতম সদস্য মধুসূদন মিস্ত্রিকে নিয়ে রাহুল আজ উত্তরপ্রদেশের বদায়ুঁ যান। এখানেই এক গ্রামে সম্প্রতি দুই দলিত কন্যাকে গণধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনা ঘটেছে। রাহুল সেখানে পৌঁছে নির্যাতিতা মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ও সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে, রাজনৈতিক ভাবে দলে নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে রাখার চেষ্টা করেন। অখিলেশ সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি সিবিআই তদন্তের দাবি তুলে তিনি বলেন, “নিছক আর্থিক ক্ষতিপূরণের কোনও মানেই হয় না।”
এক বর্ষীয়ান নেতার বক্তব্য, “অতীতেও যত বারই ভোটে ভরাডুবি হয়েছে কংগ্রেসের, তত বারই দলে ভাঙনের পরিস্থিতি হয়েছে।” এই সূত্রে ১৯৬৯ সালে কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ টানাপড়েনের প্রসঙ্গও তুলে আনছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। কামরাজের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেটের সঙ্গে ইন্দিরা গাঁধীর সংঘাতে ওই বছর দলে ভাঙন ধরে। তবে ইতিহাস বলছে, চুয়াল্লিশের চৌহদ্দিতে থমকে যাওয়ার মতো ঘোর দুর্দশায় আগে কখনও পড়েনি কংগ্রেস। এখনকার গাঁধী পরিবার কংগ্রেসকে এই সঙ্কট থেকে বের করে আনতে কোন পথ নেয়, সেটাই সব চেয়ে বড় প্রশ্ন এখন দলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy