কোনও নির্দেশ নয়, একটি মন্তব্য করে লোকসভার বিরোধী দলনেতার পদ নিয়ে বিতর্ক উস্কে দিল সুপ্রিম কোর্ট।
লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন ঘোষণা করে দিয়েছেন, চলতি লোকসভায় বিরোধী দলনেতার পদ পাবে না কংগ্রেস। তবু সুপ্রিম কোর্ট আজ অন্য একটি মামলার শুনানির সময়ে ফের টেনে নিয়ে এল প্রসঙ্গটি। সর্বোচ্চ আদালত লোকসভার স্পিকারের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলল না ঠিকই। কিন্তু জানিয়ে দিল, বিরোধী দলনেতা যে হেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ, তাই এই বিষয়ে সরকার তার অবস্থান দ্রুত স্পষ্ট করুক।
আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের দায়ের করা এক মামলার শুনানি চলছিল প্রধান বিচারপতি আর এম লোঢার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে। লোকপাল বিলের অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতির অভিযোগ নিয়ে এই মামলা অনেক দিন ধরেই চলছে। আজ শুনানির সময় প্রশান্ত ভূষণের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়, ইউপিএ আমলে পাশ হওয়া লোকপাল বিলে লোকপাল নিয়োগের জন্য লোকসভার বিরোধী দলনেতাকে সামিল করা হয়েছে। কিন্তু এখন তো বিরোধী দলনেতাই নেই! প্রধান বিচারপতি লোঢা এই সূত্র ধরেই বলেন, বিরোধী দলনেতার পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার পক্ষের থেকে ভিন্ন মত রাখেন তিনি। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে যখন কোনও বিরোধী দলনেতা নেই, তখন এটিকে খতিয়ে দেখা দরকার। সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে ফের এই মামলার শুনানি হবে। তার আগে সরকারকে এই বিষয়ে তাদের অবস্থান জানাতে হবে। আদালত এ দিন স্পষ্ট করে দিয়েছে, বিরোধী দলনেতার পদে কেউ না থাকলেও লোকপালের বিষয়টি ঠান্ডাঘরে ফেলে রাখা চলবে না। আদালত এই বিষয়ে সরকারের কাছে ব্যাখা চেয়েছে। পাশাপাশি প্রশ্ন তুলেছে, এই আইনের জন্য বিরোধীদের সব থেকে বড় দলের নেতাকে বিরোধী দলনেতার মর্যাদা দেওয়া হবে কি না। কোনও বিরোধী দলনেতা না থাকলে কী ভাবে লোকপাল নিয়োগ করা যায়, তা দেখার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগিকে নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
নরেন্দ্র মোদী সরকার যখন থেকে বিচারপতি নিয়োগ বিল পাশ করাতে সক্রিয় হয়েছে, তখন থেকেই বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সরকারের একটি অলিখিত সংঘাত শুরু হয়ে গিয়েছে। সংসদে এই বিল পাশের পরেও প্রধান বিচারপতি লোঢা প্রকাশ্যে তাঁর অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। বুঝিয়ে দেন, সংবিধানে সীমারেখা বেঁধে দেওয়া হলেও বিচারব্যবস্থার ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করছে সরকার। আজ সুপ্রিম কোর্ট যে ভাবে বিরোধী দলনেতা নিয়ে প্রশ্ন তুলল, তার মধ্যে অনেকে সেই অসন্তোষেরই ছাপ দেখছেন।
বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সরকার কিংবা আইনসভার সংঘাত অবশ্য নতুন নয়। ২০০৫ সালে অর্থের বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন করার অপরাধে লোকসভার তৎকালীন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় যখন দশ জন সাংসদকে বহিষ্কার করেন, তখন সেই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন এক বহিষ্কৃত সাংসদ। সুপ্রিম কোর্ট সেই সময় স্পিকারকে নোটিসও পাঠিয়েছিল। কিন্তু সোমনাথবাবুর উদ্যোগে ডাকা এক সবর্দল বৈঠকে সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেন, বহিষ্কারের এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে সংসদেরই। কোর্ট এখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টের এ দিনের মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সোমনাথবাবু বলেন, “এ ক্ষেত্রে আদালত স্পিকারের এক্তিয়ার নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেনি। সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে মাত্র। স্পিকারের অধিকার নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না। তবে আমার ব্যক্তিগত মত, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলনেতার দরকার আছে।”
স্পিকার সুমিত্রা মহাজন বিরোধী দলনেতা পদের বিষয়টি খারিজ করার পর সুপ্রিম কোর্ট আজ যে ভাবে বিষয়টি উস্কে দিয়েছে, তাতে উৎসাহিত কংগ্রেস। নতুন বিতর্কে তারা খুশি। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে সরকার মতামত জানানোর আগেই বিজেপির মুখপাত্র মীনাক্ষী লেখি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, সরকার কী অবস্থান নিতে চলেছে। তিনি বলেন, “বিরোধী দলনেতার পদটি মানুষই তৈরি করেন। তাঁরা যাদের সংসদে পাঠান, তার ভিত্তিতেই এই পদ তৈরি হয়। এর আগেও সাত বার বিরোধী দলনেতার পদে কেউ ছিলেন না। আজও থাকার কথা নয়।” বিজেপি নেতৃত্বের মতে, বিচারপতি নিয়োগ বিলে বিরোধী দলনেতার বদলে বিরোধী শিবিরের সবথেকে বড় দলের নেতাকে সামিল করা হয়েছে। লোকপাল-সহ বাকি বিলগুলিতেও যা যা সংশোধন প্রয়োজন, সেগুলিও করে নেওয়া হবে। তবে কংগ্রেসকে এই পদ দেওয়া যাবে না।
এ দিন প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা সলমন খুরশিদ বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানাচ্ছি। সব সময় সংখ্যার নিরিখে সব কিছু নির্ধারণ করা যায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লোকপাল, সিভিসি-র মতো সাংবিধানিক সংস্থাগুলি তৈরি হয়েছে, যেখানে লোকসভার বিরোধী দলনেতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ৫০ বছর আগে এ সব ছিল না। ফলে এখন বিরোধী দলনেতাকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।” স্পিকার খারিজ করার পরেও কংগ্রেস আশায় রয়েছে, যদি শীর্ষ আদালত সরকারকে আরও চেপে ধরে। কিন্তু বিজেপির এক শীর্ষ নেতা বলেন, “যখন সরকার দুর্বল হয়েছে, তখনই বিচারব্যবস্থা অতি-সক্রিয়তার সুযোগ পেয়েছে। বিপুল জনমতের পর মোদী সরকার এখন প্রবল শক্তিশালী। ফলে বিচারব্যবস্থা বিতর্ক উস্কে দিতেই পারে। কিন্তু ছোবল মারতে পারবে না।” ওই নেতার কথায়, “বিচারপতি নিয়োগ বিল নিয়ে বিচারব্যবস্থার যতই অসন্তোষ থাকুক, ভুলে গেলে চলবে না, সংসদে শাসক-বিরোধী দুই পক্ষ মিলেই এটি পাশ করেছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy