প্রিমিয়ার শো-তেই এত হুজুগ! ছবি হিট করবে তো? ইদুগিরি সন্দিতি জগন্মোহন রেড্ডিই কি তবে তেলুগু রাজনীতির নতুন নায়ক?
এখন বুঝছি, শ্রীনিবাস মিছে ভয় দেখায়নি! ভিনুকুন্ডার গাঁধী মূর্তিকে পিছনে ফেলে ডান দিকে লইয়ার্স রোড। রাস্তার পাশেই ওঁর বাড়ি। বলল, “ফুটপাথে দাঁড়াবেন না! ছাদে চলে যান। কেউ পা মাড়িয়ে দিতে পারে, অথবা বেমক্কা কনুইয়ের গোঁত্তা খাবেন!” এর পর সওয়া ঘন্টা ধরে যে রোড শো দেখা গেল সে বর্ণনায় আপাতত যাচ্ছি না। তার পরের প্লটটা বরং নতুন। হয়তো রোড শো-র রাজনীতিরও এক দাগ ওপরে!
তেমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে সত্তর ছুঁই ছুঁই কমলা, ওঁর প্রতিবেশী করুণা, রাধিকা, আর রাধিকার ছোট্ট মেয়ে লিকিতা। শো- শেষ হতেই জগন নামলেন গাড়ি থেকে। কমলাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমো এঁকে দিলেন। লিকিতার মাথায় আদুরে হাত রাখলেন। অত উঁচু রথ থেকে নেমে ভোট চাওয়ার এমন সহজ আবদার, নতুন নয়?
কিন্তু মানুষকে আবেগে ভাসাবার এই দৃশ্যই কি রাজনীতিতে শেষ কথা? পাঁচ বছর আগে মছলিপট্টিনামেও তো এমনই দেখেছিলাম। সেই আন্নাইদা, আন্নাইদা চিৎকার! সে ছবি-র নাম ভূমিকায় ছিলেন তেলুগু সুপারস্টার চিরঞ্জীবী। তাঁর রুপোলি পর্দার ছবি ‘শঙ্কর দাদা এমবিবিএস’ তখন হিট করেছে। কিন্তু রাজনীতির ছবিটা অমিতাভ বচ্চনের ‘আজুবা’ বা ‘তুফানের’ মতোই ব্যালট বাক্সে ডাহা ফেল! প্রজারাজ্যম দলটির অস্তিত্বই শেষ। একেবারে বিলীন কংগ্রেসে!
এ বারের ছবিতে অবশ্য ফারাক রয়েছে। রাজনীতিতে চিরঞ্জীবী ছিলেন আনকোরা। কেস স্টাডি বলতে সামনে ছিল সিনেমা থেকে রাজনীতিতে আসা তারকা রাম রাওয়ের উত্থানের পাণ্ডুলিপি। কিন্তু ভিনুকুণ্ডায় জগনের অনুরাগীরা বলছেন, “ওর রক্তে রাজনীতি, রাজশেখর মিশে রয়েছেন ওঁর সবকিছুতে।” সত্যিই, জগনের কাছে রাজনীতি দুম করে মাথায় চেপে বসা রোমান্টিকতা নয়! বাবার হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছিলেন, এ বার নতুন দল গড়ে সাড়া ফেলেছেন তিনি। তবে এই ছবিতে জগন মুখ্য চরিত্র হলেও, তাঁকে আরও উচ্চতা দিতে রয়েছেন মা বিজয়াম্মা, বক্তৃতায় ক্ষুরধার বোন শর্মিলা, স্ত্রী ভারতী। ছেলে উত্তরে ঘুরলে মা চলে যাচ্ছেন দক্ষিণে, মেয়ে পুবে। ঘর, তথা কাড়াপা- পুলিভেন্দুলার দুর্গ সামলাচ্ছেন স্ত্রী।
কাডাপার সাংসদ জগন। এ বার তাঁর নিশানা অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রীর তখত। তাই লড়ছেন পুলিভেন্দুলার বিধানসভা আসনে। কাড়াপা লোকসভায় প্রার্থী করেছেন খুড়ততো ভাই অবিনাশকে। দক্ষিণে দুই ভাই এ ভাবে ঘাঁটি ধরে রেখে কৌশলে মা-কে প্রার্থী করেছেন বিশাখাপত্তনমের লোকসভা আসনে। মামা সুব্বা রেড্ডি লোকসভায় লড়ছেন ওঙ্গোল থেকে। আর বোন শর্মিলা প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরার রোল-টাই নিয়েছেন। দাদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিন রাত এক করে প্রচার করে চলেছেন।
তবে জগনের সম্ভাবনার কথা বলার আগে তাঁর উত্থানের কাহিনিটা বলা প্রয়োজন! গত লোকসভা ভোটে একমাত্র ছেলেকে রাজনীতিতে হাতে খড়ি দিয়েছিলেন কংগ্রেসের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী রাজশেখর রেড্ডি। ভোটের পর চার মাস কাটেনি, নাল্লামালার জঙ্গলে কপ্টার ভেঙে মৃত্যু হল রাজশেখরের। তখনও রাজনীতিতে থাকলেও জগনের মন ছিল তাঁর ব্যবসাতে। মাত্র ৩৭ বছর বয়সেই বিপুল সাম্রাজ্যের মালিক তখন জগন। সে যাক। রাজশেখরের শব প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্ট মতে যে দিন পুলিভেন্দুলায় কবর দেওয়া হল, তার পর দিন থেকেই জগনের বৈরাম খাঁ হয়ে উঠলেন রাজশেখরের আস্থাভাজন পরামর্শ দাতা কে ভি পি রামচন্দ্র রাও। বাবার সিংহাসন দখলের জন্য তখন থেকেই জগনকে খেপিয়ে তোলেন কেভিপি। কিন্তু তাতে বাধ সাধে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। তার পরিণামে বিদ্রোহ থেকেই জন্ম নেয় জগনের নতুন দল ওয়াই এস আর কংগ্রেস। টলমল করে ওঠে অন্ধ্রে কংগ্রেসের বসুন্ধরা। সনিয়া গাঁধীকে স্বস্তি দিতে মাঝে অবশ্য মৌসুমি বায়ু এসেছিল। দুর্নীতির অভিযোগে গত সেপ্টেম্বর অবধি ১৬ মাস জেল হাজতে ছিলেন জগন। কিন্তু এর পরই মৌসুমি বায়ুকে ফের বঙ্গোপসাগরে ঠেলে দিতে মাঠে নামেন রাজশেখরের বিধবা বিজয়াম্মা ও মেয়ে শর্মিলা। কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার রাজনীতির অভিযোগ তুলে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার পদযাত্রা করে ঝড় তোলেন মা-মেয়ে। সেই ঝড় পাক খেতে খেতে এখন এমনই ঘূর্ণি তৈরি করেছে যে অন্ধ্র ভাগ করে একমাত্র তেলঙ্গানার খুঁটি আঁকড়ে থাকা ছাড়া উপায়ান্তর নেই কংগ্রেসের।
আজ এই মুহূর্তে, কংগ্রেস এবং তেলুগু দেশমের বড় অংশ চলে এসেছে জগনের দলে। যদিও চন্দ্রবাবু নায়ডু এবং অন্ধ্রের বাকি বিরোধী নেতারা বলছেন, রোড শো দেখে বিচার করলে ভুল হবে। মানুষ জানে, নিজের আর্থিক সাম্রাজ্য বাঁচাতেই জগন এখন মরিয়া। নইলে ফের জেলে যেতে হবে তাঁকে।
কিন্তু তাঁর সাফল্যের সম্ভাবনার যুক্তিই বা কম ওজনদার কীসে? রাজশেখর জমানার কর্মসূচির সুফল পেয়ে গাঁ-গঞ্জের বহু মানুষ এখনও তাঁর ছবি টাঙিয়ে রেখেছেন বাড়িতে। ছেলের কাছে বড় পুঁজি এটা। যদিও এর ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে অন্য অসুবিধা। রাজশেখর কিংবা জগনতাঁদের পরিবারের সঙ্গে এত দিন ধরে ‘হাত’ চিহ্নকেই জুড়ে দেখতে অভ্যস্ত মানুষ। এ বার নতুন প্রতীক ‘সিলিং ফ্যান’কে চেনাতে তাই হিমশিম অবস্থা। যাই হোক, জগন সমর্থকরা বলছেন, রাজশেখরের বিধবা স্ত্রীর প্রতি অন্ধ্রের মানুষের সহানুভূতি, জেলে থাকার সময়টুকু বাদ দিয়ে জগনের টানা জনসংযোগ কর্মসূচি, গাঁধী পরিবারের বঞ্চনা, চন্দ্রবাবু নায়ডুকে শর্মিলার ক্ষুরধার আক্রমণ জলে যাবে নাকি?
তবু প্রশ্ন তো থেকে যায়, এ ছবি চলবে তো? বাবা-র ছবি হিট ছিল। কিন্তু জগনের কেমিস্ট্রি তেলগু দর্শক নেবেন তো? দাদু-র দৌলতে তেলুগু সিনেমায় নেমেছিলেন এন টি আর জুনিয়র। তাঁর প্রথম ছবি হিট করাতে লেগে গেছিল পাক্কা বারোটা বছর!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy