একশো দিন হতে চলল। সরকারে হিন্দুত্বের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে নিজের ‘একনায়ক’ ভাবমূর্তির বদনাম ঘোচানোও এখন একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে নরেন্দ্র মোদীর কাছে।
গোড়া থেকেই মোদী তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য ও সাংসদদের স্পষ্ট করে দিয়েছেন, বিপুল জনমত নিয়ে জেতার পর মানুষের প্রত্যাশা মেটানোই তাঁর সরকারের লক্ষ্য। আর তা শুধু উন্নয়ন ও সুশাসনের ভাবনাচিন্তা, প্রয়াসের মাধ্যমেই হতে পারে। সঙ্ঘের ‘কোর অ্যাজেন্ডা’ পূরণ করা যে তাঁর আশু লক্ষ্য নয়, তা-ও তিনি আরএসএস নেতৃত্বকে জানিয়েছেন। সে কারণেই নতুন সরকারের জন্মলগ্নেই প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ যখন ৩৭০ ধারা বিলোপের প্রসঙ্গকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছিলেন, মোদী তাঁকে ধমক দিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বলেন। পরের মন্ত্রিসভার বৈঠকে মোদী সকলকে জানিয়ে দেন, মনমোহন সিংহ সরকার সিদ্ধান্তহীনতা, নীতিপঙ্গুত্বের শিকার ছিল। তাকে বদলে, বিপুল ভোট দিয়ে মানুষ একটি স্থায়ী সরকার তৈরি করেছে এই আশায়, যাতে এই সরকার দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সরকারিতন্ত্রের খোলনলচে বদলে তাই দিনরাত মানুষের স্বার্থে কাজ করে যেতে হবে।
কিন্তু দল ও সরকারের রাশ মোদী যে ভাবে নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন, তা নিয়েও সমালোচনার মুখোমুখি তিনি। বিরোধী দলের নেতারা মোদীকে ‘হিটলার’ উপাধি আগেই দিয়েছেন। তার উপর লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলী মনোহর জোশীদের ‘বৃদ্ধাশ্রমে’ পাঠানো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে উঠতে-বসতে বিবাদ নিয়ে রোজই মোদীকে কটাক্ষ করছেন বিরোধীরা। মোদীর ভয়ে তটস্থ তাঁর মন্ত্রীরাও। সম্প্রতি এক মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে ‘ভিশন ডকুমেন্ট’ নিয়ে যাননি বলে তাঁকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মোদী। রাতে তাঁর বাড়িতে লোক পাঠিয়ে মোদী বলেন, ‘কাল সকালে নথি নিয়ে যেতে না পারলে ইস্তফা দিন।’ মোদীর ভয়ে মন্ত্রীরা এখন প্রকাশ্যে মুখ খুলতেও পারছেন না। বিরোধীরা যে ভাষায় কটাক্ষ করছেন মোদীকে, ঘরোয়া স্তরে প্রায় একই সুরে বক্তব্য রাখছেন নিজের দলের নেতারা।
সরকারের একশো দিনের মাথায় এই একনায়কের বদনাম ঘোচানো মোদীর কাছে চ্যালেঞ্জ। আজ মোদী সরকারের অন্যতম সেনাপতি অরুণ জেটলি যখন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন, তাঁকেও এই প্রশ্ন শুনতে হয়। প্রশ্ন করা হয়, ইউপিএ জমানায় মনমোহন সিংহকে বলা হত, তিনি রিমোট কন্ট্রোলে চলতেন, আর নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁর হাতে অনেক বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে! জেটলি বলেন, “নরেন্দ্র মোদীর হাতে অনেক বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে, এটি আদৌ কোনও বিতর্কের বিষয় নয়। আমি নিজেও বিভিন্ন মন্ত্রকের দায়িত্বে রয়েছি। সেখানে অনেক বেশি বিকেন্দ্রীকরণের স্বাধীনতা উপভোগ করি।” জেটলির যুক্তি, “প্রধানমন্ত্রী যদি অতিসক্রিয় থেকেও বিভিন্ন মন্ত্রককে এমন স্বাধীনতা দেন, তা হলে সকলের মধ্যে দায়িত্ববোধ চলে আসে। মন্ত্রকই সেই সিদ্ধান্তই নেয়, যা প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর সচিবালয় অনুমোদন করে।” মোদীর আর এক চিন্তা হিন্দুত্বের ভাবনা থেকে সরকারকে বাঁচানো। লোকসভার আগে দ্বিমুখী কৌশল নিয়ে এগিয়েছিল সঙ্ঘ ও বিজেপি। নরেন্দ্র মোদী তুলে ধরেছেন উন্নয়নের প্রসঙ্গ, আর সঙ্ঘ বলেছে হিন্দুত্বের কথা। কিন্তু সরকারের একশো দিনের মাথায় মোদী বুঝতে পারছেন, তাঁর সরকারেও হিন্দুত্বের আঁচ পড়তে শুরু করেছে। সঙ্ঘের সঙ্গে বিজেপি নেতারাও কখনও ধর্মান্তকরণ নিয়ে সোচ্চার হচ্ছেন, কখনও উগ্র হিন্দুত্ব উস্কে দেওয়া কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে বিজেপি সাংসদের মুখে। কেন্দ্রের সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রী নাজমা হেফতুল্লাও সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের সুরে ভারতের সব নাগরিককে ‘হিন্দু’ বলতে শুরু করেছেন। বিজেপি সূত্রের মতে, দলের সভাপতি অমিত শাহকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ, হিন্দুত্ব নিয়ে সঙ্ঘ নেতারা যা-ই বলুন না কেন, দল ও সরকারকে তার থেকে দূরে রাখতে হবে। নাজমাকে মোদীই সাফাই দিতে বলেছেন। আর সঙ্ঘ নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে বিজেপিকে হিন্দুত্ব থেকে দূরে রাখার বিষয়টি সুনিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন মোদী। বিজেপি সূত্রের মতে, আরএসএস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতাদের মোদীর এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন অমিত শাহ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy