Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Year End Special

সব ওদের জন্য, সব আমাদের জন্য

এই বছরটাও চলেই গেল। দাঁতে দাঁত চেপে কাটিয়ে দিতে পেরেছি এই বছরটাও। তবে চাহিদা অনেক। ঝুলি উপুড় করে দিতে হবে নতুন বছরকে।

বলতে ইচ্ছে করে নতুন বছরের কথা। আগামীর কথা। রূপকথা তৈরি করতে ইচ্ছে করে আমাদের। যারা এই আকালেও স্বপ্ন দেখে। অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ

বলতে ইচ্ছে করে নতুন বছরের কথা। আগামীর কথা। রূপকথা তৈরি করতে ইচ্ছে করে আমাদের। যারা এই আকালেও স্বপ্ন দেখে। অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ

উদ্দালক ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২০ ১৭:১৯
Share: Save:

যে তরুণ লকডাউনে চাকরি হারিয়েও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে নতুন চাকরির খোঁজে, রোজ বাড়িতে ফিরে মায়ের হাতের রান্না খাচ্ছে, স্ত্রী-র খেয়াল রাখছে, পরদিন আবার সামান্য সঞ্চয়ের অর্থ পকেটে করে বেরিয়ে পড়ছে চাকরি খুঁজতে— তার বেঁচে থাকার ইচ্ছার জন্য এই লেখা।

যে কলেজ পড়ুয়া মেয়েটি অনলাইন ক্লাস করতে স্বল্প আয়ের বাবা-মায়ের উপর নতুন চাপ না বাড়িয়ে নিজের টিউশনের টাকা জমিয়ে কিনেছে কমদামি স্মার্ট ফোন, যে স্বপ্ন দেখে একদিন সে বিজ্ঞানী হবে— তার বুকের ভিতরে চাপা অদম্য জেদের জন্য এই লেখা।

যে ছেলেটা স্ত্রী-র কাছে যেতে পারেনি আট মাস, দেখতে পায়নি সন্তানের মুখ, চাকরির জন্য যে ছেলে প্রায় পুরো বছরটাই পরিবার-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রইল বিদেশে— এই লেখা সেই ছেলের বুকের চাপা কষ্টের জন্য রইল।

যে যুবক হতচ্ছাড়া ভাইরাসের দাপটে প্রেমিকাকে ছুঁয়ে দেখতে পারেনি দীর্ঘদিন, ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ভুলে যেতে পারেনি চাপা কষ্ট— এই লেখা থাক তার জন্য।

যে সন্তান তার মায়ের মৃত্যুর পর মুখাগ্নি করতে পারল না, যে মেয়েটি তার বন্ধুর অসুস্থতার সময় হাসপাতালে গিয়ে সান্ত্বনা দিতে পারল না, যে কমরেড তার মিছিলে-হাঁটা সঙ্গীর মৃত্যুর খবর পেয়ে একদিন সকালে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল— এই লেখা থাক ওদের সকলের জন্য।

যে তরুণ লকডাউনে চাকরি হারিয়েও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে নতুন চাকরির খোঁজে, তার বেঁচে থাকার ইচ্ছার জন্য এই লেখা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

ছটফটে ছেলেটার বাড়িতে থাকতে মন চায় না। উজ্জ্বল মেয়েটি ইউনিভার্সিটি আর ল্যাব ছাড়া কিছু বোঝে না। অথচ হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো এক রোগ এসে সেসব বন্ধ করে দিল ২০২০। ২০২১ তাই সমুদ্রমন্থনে ওঠা অমৃতের ভাণ্ডের মতো আকাঙ্খিত মানুষের কাছে। নতুনে বুঝি শেষ হবে এই যন্ত্রণা। শেষের দিনে ফেলে আসা বছরের আস্ত ৩৬৫ দিনের সমস্ত না-পাওয়া মিটিয়ে নেওয়ার উদগ্র বাসনা কাজ করে আমাদের মনে।

আর আমি? আমিও সেই উর্দ্ধকমার মধ্যে, যাদের বয়সে সবে মধ্যাহ্নের সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়েছে। কিশোর থেকে তরুণ হয়েছে যে বা তরুণ থেকে যে হয়েছে যুবক। চোখ জ্বলজ্বল করছে, পেশিতে শক্তি ফুলে ফুলে উঠছে, মনে মনে ভীষণ কিছু একটা করে ফেলার ফুটন্ত লাভা নিয়ে যারা ঘুরে বেড়ায়, আমিও তাদের একজন। তাই বলতে বড় ইচ্ছা করে। ফেলে আসা বছরের কথা নয়। বলতে ইচ্ছে করে নতুন বছরের কথা। আগামীর কথা। রূপকথা তৈরি করতে ইচ্ছে করে আমাদের। যারা এই আকালেও স্বপ্ন দেখে।

আর পাঁচটা বছরের মতো না হলেও এই বছরটাও চলেই গেল। দাঁতে দাঁত চেপে কাটিয়ে দিতে পেরেছি এই বছরটাও। তবে চাহিদা অনেক। ঝুলি উপুড় করে দিতে হবে নতুন বছরকে। স্বপ্ন নয়, প্রতিটা অক্ষর যাতে সত্যি হয় এ বারে। নতুন বছরে সূর্যোদয়ের মুহূর্ত থেকে যেন ঝনঝন করে বেজে ওঠে নাচের তাল। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা একটানা এতগুলো দিন ধরে কমিউনিটি কিচেনের স্বপ্নের জন্ম দিয়েছে, আমার মতো সেই তরুণরাই চায় মানুষের মুখে মুখে পৌঁছে দিতে দিনের খাবার। কেউ যেন অভুক্ত না থাকে। একক চাহিদায় আর কবে গুরুত্ব দিয়েছে তারা? তারাই তো কখনও আমেরিকায়, কখনও মেদিনীপুরে, কখনও গুয়াতেমালায়, কখনও ঢাকায় মানুষের অধিকারের দাবিতে পরোয়া না করে পথে নেমেছে সবার আগে।

এবারও আমরা চাই, অভাব থাক, কিন্তু অসাম্য দূর হতে শুরু করুক নতুন বছরে।

চাই, নতুন বছর নিয়ে আসুক কাজের খবর। যে একা মেয়েটার ঘাড়ে মা-বাপের সংসারের দায়িত্ব, চাই সেই মেয়েটি যেন কলেজ পাশ করে বেরিয়ে একটা কাজ পায়। বছরের পর বছর যেন তাকে হা পিত্যেশ করে বসে থাকতে না হয় একটা চাকরির জন্য। কাজের দাবিতে বুকের ভিতর পাথর চাপা দিয়ে দেশে-মহাদেশে তাকে যেন পথে নামতে না হয়। নতুন বছরে স্বপ্ন দেখি এক এমন বিশ্বের। যেখানে ছেলেমেয়েরা সকালে উঠে দৌড়বে কাজে। কৃষকের ছেলে ফসল বুকে আগলে রাখবে নিশ্চিন্তে। সদ্য চাকরি পাওয়া ছেলে অভাবী মায়ের জন্য নিয়ে যাবে নতুন তাঁতের শাড়ি। মেয়েটা যত্ন করে জমিয়ে রাখবে টাকা। একদিন একা তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে ছুটির দিন উপভোগ করবে বলে।

যে কলেজ পড়ুয়া মেয়েটি অনলাইন ক্লাস করতে স্বল্প আয়ের বাবা-মায়ের উপর নতুন চাপ না বাড়িয়ে নিজের টিউশনের টাকা জমিয়ে কিনেছে কমদামি স্মার্ট ফোন, যে স্বপ্ন দেখে একদিন সে বিজ্ঞানী হবে— তার বুকের চাপা অদম্য জেদের জন্য এই লেখা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

সালমা ভালবাসে প্রতীককে। নতুন বছরে প্রতিটা সালমা যেন প্রত্যেক প্রতীকের কাছে যেতে পারে। অনির্বাণ অনিরুদ্ধকে ভালবাসে। নতুন বছরে প্রতিটা অনিরুদ্ধ যেন প্রত্যেক অনির্বাণের কাছে যেতে পারে। মালতী ভালবাসে প্রিয়াকে। প্রতিটা মালতী যেন প্রিয়ার কাছে যেতে পারে। কোনও এক রাতে, অন্ধকারে, পুকুর পাড়ের গাছে যেন সালমা-প্রতীক, অনির্বাণ-অনিরুদ্ধ, মালতী-প্রিয়ার আত্মঘাতী ঝুলন্ত দেহ দেখতে না হয় নতুন বছরে। ভালবাসা যেন সব অর্গল ভেঙে ফল্গুধারার মতো বয়ে যায় সমাজের শরীরে। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ— সবগুলো যেন একটা বাক্সে তালা বন্ধ করে ফেলে দিতে পারি অগাধ জলে। আমার রাষ্ট্র যেন আমায় চোখ না রাঙায়। যেন না ঠিক করে দেয়, আমি কাকে ভালবাসব। পুরাতনীদের কাছে চেয়ে নেওয়া নয়, আমরা ছিনিয়ে নেব কৃষ্ণচূড়ামাখা এক পৃথিবী।

নতুন বছরে কেউ পদোন্নতির জন্য একে অপরকে ধাক্কা মেরে দৌড় থেকে ছিটকে দিয়ে এগিয়ে যাব না। সবাইকে সমান করে রাখব। ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেব ‘ওদের’।

২০২০ সালের গোড়ার দিকে এক তরুণের ছবি ভাইরাল হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফুড ডেলিভারি অ্যাপের কর্মী সেই তরুণের সদাহাস্য ছবি দেখে যেমন মনটা নেচে উঠেছিল, তেমন ছন্দে নেচে যাবো নতুন বছরে। প্রেমিকাকে ছুঁয়ে দেখব। মাকে কিনে দেব নতুন শাড়ি। মাথা উঁচু করে ঢুকব কর্মক্ষেত্রে। বন্ধুদের নিয়ে খেতে যাব রেস্তোরাঁয়। এটুকুই তো চাই। ‘ওরা’ ক্ষমতা দখল করার স্বপ্ন দেখুন, মানুষকে লুঠ করার স্বপ্ন দেখুন, ষড় করে এদেশ-ওদেশ যুদ্ধ বাধান। আমরা বারবার ইতিহাসের নিয়ম মেনে দাঁড়িয়ে পড়ব দোনলা বন্দুকের সামনে।

‘ভয় নেই

আমি এমন ব্যবস্থা করব, যাতে সেনাবাহিনী

গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে

মার্চপাস্ট করে চলে যাবে

এবং স্যালুট করবে

কেবল তোমাকে প্রিয়তমা’।

ঋণ: শাহাদুজ্জামান, শাহীদ কাদরি, কবীর সুমন।

আরও পড়ুন: বিষ সাল বাদ

আরও পড়ুন: দিন যায়, রাত আসে, ডায়েরির পাতা ওল্টায় করোনা

অন্য বিষয়গুলি:

Year End Special Covid-19 Coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy