শিবরাজ সিংহ চৌহান। — ফাইল চিত্র।
শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানমুখী হাওয়াতেই সওয়ার হল মধ্যপ্রদেশ। বিজেপির কাছে জবাব চাওয়ার ভোটে উল্টে কংগ্রেস উঠে গেল কাঠগড়ায়। একাধিক বুথ ফেরত সমীক্ষার পূর্বাভাস মিলিয়ে সেখানে ক্ষমতায় ফিরতে চলেছে বিজেপি।
যদিও মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান টানা পঞ্চম বার ভোপালের কুর্সিতে ফিরতে চলেছেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কারণ ‘তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে’ চার বারের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজকে এ বার ভোটের আগে ‘মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী’ হিসাবে ঘোষণা করেনি বিজেপি। ভোটের প্রচারেও ‘মামা’র (অনুগামীদের কাছে এই নামেই পরিচিত শিবরাজ) তুলনায় ‘মোদীত্বে’ বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফলাফল বিশ্লেষণের প্রাথমিক প্রবণতা বলছে, বিজেপির জয়ে তাঁর অবদান কম নয়।
২৩০ আসনের মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় জয়ের জাদুসংখ্যা ১১৫। গণনায় প্রবণতা বলছে অনায়াসে তা অতিক্রম করতে চলেছে বিজেপি। শিবরাজ তাঁর বুধনি কেন্দ্রে জিততে চলেছেন। কৈলাস বিজয়বর্গীয় (ইন্দোর-১), প্রহ্লাদ পটেল (নরসিংহপুর)-সহ বিজেপির প্রথম সারির নেতাদের অধিকাংশই জিততে চলেছেন। তবে দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফগ্গন সিংহ কুলস্তে এবং নরেন্দ্র সিংহ তোমর পিছিয়ে। কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী কমল নাথও নিজের কেন্দ্র ছিন্দওয়াড়ায় জিততে চলেছেন।
অতীতে প্রধানমন্ত্রী মোদী বার বার জনমুখী আর্থিক সাহায্যকে ‘রেউড়ি সংস্কৃতি’ বলে কটাক্ষ করেছেন। কিন্তু ভোটের মুখে তাঁরই দলের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ ‘লাডলি বহেন যোজনা’য় মহিলাদের আর্থিক সাহায্যের অঙ্ক হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কয়েকটি বুথ ফেরত সমীক্ষায় স্পষ্ট তার প্রভাব ধরা পড়েছিল। পুরুষদের ভোটে তুল্যমূল্য লড়লেও মহিলাদের ভোটের ক্ষেত্রে বিজেপি কংগ্রেসের তুলনায় প্রায় ৮ শতাংশে এগিয়ে থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। ফল বলছে তা মিলতে চলেছে। কংগ্রেস ভোটের আগে টাকা বিতরণ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও তা কার্যত বুমেরাং হয়েছে।
শুধু লাডলি বহেন যোজনা নয়, শিবরাজের প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল প্রতি পরিবারের কন্যাসন্তানকে দু’লক্ষ টাকা আর্থিক সাহায্য, উজ্জ্বলা এবং লাডলি বহেন যোজনার আওতায় থাকা পরিবারকে ৪৫০ টাকায় গ্যাস সিলিন্ডার, গরিব পরিবারকে আগামী পাঁচ বছর বিনামূল্যে রেশন, কৃষিপণ্যে সহায়ক-মূল্য বৃদ্ধি ছাড়াও কৃষক সম্মাননিধি প্রকল্পে প্রত্যেক কৃষককে ১২ হাজার টাকা সাহায্যের কথা। তারই স্রোতে ভর করে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া অতিক্রম করলেন তিনি। পিছনে ঠেলে দিলেন ভোটের প্রচারে কংগ্রেসের তোলা দুর্নীতি, রোজগারের অভাব, কৃষকদের ফসল না পাওয়ার মতো বিষয়গুলিকে। রাহুল গান্ধীর জাতগণনার প্রতিশ্রুতি উচ্চবর্ণের ভোট আরও বিজেপিমুখী করেছে বলেও মনে করা হচ্ছে।
ভোটের পরে মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস নেতা কমল নাথ, দু’জনেই ১৩০-এর বেশি আসন জেতার দাবি করেছিলেন। যদিও বেশ কয়েকটি বুথ ফেরত সমীক্ষার ইঙ্গিত ছিল, ২০১৬ সালের মতো দু’দলই সেঞ্চুরি করলেও ২৩০ আসনের মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জাদুসংখ্যা ১১৬ ছুঁতে পারবে না। কিন্তু রবিবার সকাল ৮টায় ভোটগণনা শুরুর পরে প্রাথমিক ভাবে ‘কাঁটে কা টক্কর’-এর ইঙ্গিত এলেও বেলা গড়াতেই স্পষ্ট হয়, গেরুয়া হাওয়ার সামনে মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে কংগ্রেস। মহিলা ভোটের পাশাপাশি, জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডের ভূমিকা এবং বিরোধী শিবিরে অনৈক্যও কংগ্রেসের পরাজয়ের অনুঘটক হয়েছে বলে ভোটপণ্ডিতদের একাংশ মনে করছেন।
২০১৩ সালে মধ্যপ্রদেশের ২৩০টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ১৬৫টি, কংগ্রেস ৫৮টি। দু’দলের ভোট শতাংশের ফারাক ছিল প্রায় ৯ শতাংশ (বিজেপি প্রায় ৪৫ শতাংশ। কংগ্রেস ৩৬ শতাংশের সামান্য বেশি)। কিন্তু ২০১৮-র বিধানসভা ভোটে ৪১ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে টেক্কা দেয় কংগ্রেস। বিজেপির ঝুলিতে যায় ৪০.৮ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস ১১৪, বিজেপি ১০৯, বিএসপি ২ এবং নির্দল ও অন্যেরা ৫টি আসনে জেতে। শেষ পর্যন্ত বিএসপি এবং নির্দলদের সমর্থনে সরকার গড়ে কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী হন কমল। কিন্তু জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডের নেতৃত্বে ২০২০-র মার্চে ২২ জন কংগ্রেস বিধায়কের বিদ্রোহের জেরে গদি হারিয়েছিলেন কমল। চতুর্থ বারের জন্য ভোপালের কুর্সি গিয়েছিল শিবরাজের কব্জায়। সেই হিসাবে কংগ্রেসের কাছে লড়াই ছিল ‘শোধ তোলার’। যাতে ব্যর্থ হলেন রাহুল গান্ধী, মল্লিকার্জুন খড়্গে, কমল নাথেরা।
বস্তুত, পঞ্চম বারের জন্য বিজেপির ‘মামা’ মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন কি না, গোয়ালিয়রের ‘মহারাজ’ জ্যোতিরাদিত্যের উপরে তা কিছুটা নির্ভর করছিল বলে ভোটপণ্ডিতদের একাংশের ধারণা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, গত বারের বিধানসভা ভোটের আগে কংগ্রেসে থাকাকালীন ঠারেঠোরে নিজেকে মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবিদার হিসেবে তুলে ধরলেও এ বার গোড়াতেই সেই দৌড় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন জ্যোতিরাদিত্য। বিজেপির প্রতিটি জনসভায় নিয়ম করে তিনি বলছেন, ‘‘আমি মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নই!’’ যা দেখে অনেকে বলছেন, শুধু শিবরাজ নন, এ বারের বিধানসভা ভোট যে তাঁরও রাজনৈতিক কেরিয়ারের ‘অগ্নিপরীক্ষা’, তা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন মহারাজ। নিজের খাসতালুক চম্বল-গোয়ালিয়রে বিজেপিকে জেতানোর গুরুদায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে।
ভোটের ফল বলছে সে দায়িত্বে সফল হয়েছেন জ্যোতিরাদিত্য। অন্য দিকে, বিজেপির মোকাবিলায় কংগ্রেসের বাজি ছিল দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমল এবং দিগ্বিজয় সিংহের জুড়ি। ‘শোলে’ ছবির অনুকরণে যাঁরা মধ্যপ্রদেশ কংগ্রেসের ‘বীরু-জয় জোড়ি’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছেন। অতীতে মধ্যপ্রদেশ কংগ্রেস যাঁদের গোষ্ঠীলড়াইয়ের সাক্ষী হলেও জ্যোতিরাদিত্য দল ছাড়ার পরে গত সাড়ে তিন বছরে দু’জনের সমীকরণ অনেকটাই মসৃণ হয়েছিল। প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিংহের ছেলে অজয় এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুরেশ পচৌরির অনুগামী কংগ্রেস নেতা-কর্মীরাও ‘মূলস্রোতে’ ছিলেন। যদিও বিজেপির মতোই বেশ কিছু আসনে কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ নেতারা গোঁজ প্রার্থী হয়েছিলেন। ভোটের ফলে তার প্রভাব পড়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রভাব পড়েছে ‘ইন্ডিয়া’-সহ অন্য বিজেপি বিরোধীদের মধ্যে অন্তর্বিরোধ এবং ভোট কাটাকাটি।
কংগ্রেস-বিজেপির পাশাপাশি, মায়াবতীর বিএসপি-ও এ বার লড়েছিল ২৩০টি বিধানসভা কেন্দ্রে। কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা না হওয়ায় ‘ইন্ডিয়া’র শরিক সমাজবাদী পার্টি ৭১ (আঞ্চলিক দলকে ৯টি আসনে সমর্থন করেছিল), আম আদমি পার্টি ৬৯, জেডিইউ ৫, সিপিআই ৯টি এবং সিপিএম ৪টি আসনে আলাদা আলাদা ভাবে লড়ছিল। বুন্দেলখণ্ড, বাঘেলখণ্ড, বিন্ধ্য (নিমার) অঞ্চলের বেশ কিছু আসনে বিরোধী ভোট ভাগাভাগির সুফল পেয়েছে বিজেপি। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কমলের মহাকোশল অঞ্চলেও বিজেপি এগিয়ে রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy