টিকা-নীতি বদলাতে বাধ্য হলেন প্রধানমন্ত্রী। ছবি পিটিআই।
সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন, বিরোধীদের পাশাপাশি বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের চাপ, টিকা না-পাওয়া সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় ব্যর্থতায় কেন্দ্রের দিকেই আঙুল, সর্বোপরি ‘ব্র্যান্ড মোদী’-তে কালির ছিটে— পাঁচ দফা এই চাপের মুখে আজ টিকা-নীতি বদলাতে বাধ্য হলেন প্রধানমন্ত্রী।
সোমবার বিকেল পাঁচটায় জাতির উদ্দেশে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, ১৮-৪৪ বছর বয়সিদের জন্য টিকাও এখন থেকে কেন্দ্রই জোগাবে রাজ্যকে, বিনামূল্যে। এত দিন মোদী সরকারের নীতি ছিল, স্বাস্থ্যকর্মী, ফ্রন্টলাইন কর্মী বাদে কেন্দ্র শুধু মাত্র ৪৫ বছরের বেশি বয়সিদের জন্য রাজ্যকে টিকা জোগাবে। ১৮-৪৪ বছর বয়সিদের টিকা দেওয়ার দায় রাজ্যের। আজ মোদী জানালেন, ২১ জুন যোগ দিবস থেকে সকলের জন্যই কেন্দ্র টিকা জোগাবে।
বিরোধীদের প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত প্রথমেই নিলেন না কেন? কেন সুপ্রিম কোর্টের ধমক খেয়ে বোধোদয়? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ফেব্রুয়ারি থেকে বার বার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছি, সবাইকে বিনামূল্যে টিকা দেওয়া হোক। চার মাস পরে, চাপের মুখে উনি সেটা শুনলেন। দুঃখের কথা হল, প্রধানমন্ত্রীর এই দেরিতে সিদ্ধান্তের কারণে অনেকেই প্রাণ হারালেন!”
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ধনঞ্জয় ওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ কেন্দ্রের এই নীতিকে ‘খামখেয়ালি’ ও ‘অযৌক্তিক’ বলে আখ্যা দিয়েছিল। প্রশ্ন তুলেছিল, কেন্দ্র কেন সকলকে টিকা দেবে না? টিকার জন্য বরাদ্দ ৩৫ হাজার কোটি টাকা কোথায় খরচ হচ্ছে? সব বিরোধী দল, বিজেপি, অ-বিজেপি শাসিত রাজ্য আদালতের ভিতরে-বাইরে দাবি তুলেছিল, কেন্দ্রই সকলের জন্য টিকা কিনে রাজ্য প্রশাসনের মাধ্যমে বিনামূল্যে বিলি করুক। সরকারি সূত্রের খবর, সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রকে সকলের জন্য বিনামূল্যে টিকাকরণের নির্দেশ দিয়ে দিতে পারে— মোদী সরকারের অন্দরমহলে এমন আশঙ্কা তৈরি হয়। কারণ আদালতের নির্দেশে এই কাজ করতে হলে, কোনও রাজনৈতিক কৃতিত্বই নেওয়া যেত না।
প্রধানমন্ত্রী আজ তাই এক ঢিলে তিন পাখি মারার চেষ্টা করেছেন। এক, নিজের ‘অযৌক্তিক’ নীতির জন্য তিনি রাজ্যগুলি ও বিরোধীদের দোষারোপ করেছেন। মোদীর যুক্তি, রাজ্যগুলিই টিকার দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল। তাই কেন্দ্র ১ মে থেকে ১৮-৪৪ বছর বয়সিদের টিকার দায়িত্ব রাজ্যগুলিকে ছেড়ে দেয়। মজার কথা হল, কেন্দ্রের স্বাস্থ্য মন্ত্রক যখন ১৯ এপ্রিল এই ঘোষণার সময় পুরো কৃতিত্বই নিজে নিতে চেয়েছিল। কেন্দ্র দাবি করেনি, রাজ্যের কথায় এই সিদ্ধান্ত। বিরোধীদের কটাক্ষ, মোদীর নীতি হল ঘোষণার সময় নিজের বড়াই। ভুল হলে অন্যদের দোষ!
দুই, কোর্টের নির্দেশের আগে মোদী নিজেই সকলকে টিকা দেওয়ার ঘোষণা করেছেন। চাপের মুখে সিদ্ধান্ত হলেও তার ফায়দা তুলতে বিজেপি মোদীর ‘প্রগতিশীল নীতি’-র ঢাক পেটাতে নেমেছে। তিন, কেন্দ্রের টিকা-নীতির বিরুদ্ধে মমতা, উদ্ধব ঠাকরে, পিনারাই বিজয়ন থেকে কংগ্রেস শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা এক মঞ্চে আসার পরিকল্পনা করছিলেন। ২০২৪-এর আগে বিরোধী জোটের সলতে পাকানোর সেই প্রচেষ্টাতেও মোদী আগেভাগে জল ঢালার চেষ্টা করলেন। পশ্চিমবঙ্গ-সহ কিছু রাজ্যের তরফে সংশ্লিষ্ট মুখ্যমন্ত্রীদের ছবি দিয়ে আলাদা টিকা-সংশাপত্র দেওয়া শুরু হয়েছে। কেন্দ্র তা-ও বন্ধ করতে চাইল।
চলতি বছরে এই নিয়ে তিন বার টিকা-নীতির বদল হল। ১৬ জানুয়ারি থেকে শুধু ৪৫ বছরের বেশি বয়সিদের টিকা দেওয়ার ঘোষণা হয়েছিল। ১ মে থেকে ১৮-৪৪ বয়সিদের টিকার ছাড়পত্র দিলেও তা রাজ্যকে দিতে হবে বলে কেন্দ্র জানায়। এ বার ২১ জুন থেকে কেন্দ্র সকলের টিকার খরচ জোগাবে। নীতি বদলালেও টিকার জোগান বাড়ার সম্ভাবনা নেই। প্রধানমন্ত্রী অনেক নতুন টিকা আসছে বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন। বিরোধীদের অভিযোগ, ২০২১-র ডিসেম্বরের মধ্যে কী ভাবে সকলের টিকাকরণ হবে, তার দিশা মেলেনি।
পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির প্রশ্ন, টিকা কিনতে রাজ্য যে টাকা খরচ করেছে, তা কি কেন্দ্র ফেরত দেবে? পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ২০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কেন্দ্রের থেকে দ্বিগুণ দামে রাজ্যকে টিকা কিনতে হয়েছে। এই দামের বৈষম্য নিয়েও সুপ্রিম কোর্ট ও বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছিলেন। কংগ্রেসের বক্তব্য— রাহুল গাঁধী প্রথম থেকেই বলছেন, কেন্দ্র সকলের জন্য টিকা না-জোগালে গ্রামে টিকা পৌঁছবে না। আজ সব টিকাই বিনামূল্যে দেওয়ার দাবি জানিয়ে তাঁর প্রশ্ন, বেসরকারি হাসপাতালেই বা কেন টিকার দাম নেওয়া হবে! কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “বিরোধীদের দাবি আগে কানে তুললে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষতি হত না।” পি চিদম্বরম বলেন, “নিজের ভুল থেকে সরকার শিখছে। কিন্তু নিজের ভুল বিরোধীদের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করলেন প্রধানমন্ত্রী।” সিপিএম সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য একে তুলনা করেছেন ‘গাধার জল ঘুলিয়ে খাওয়া’-র সঙ্গে। কেন্দ্রের তরফে সুকৌশলে ভাসানো হচ্ছে যে, রাহুল, মমতা, কেজরীরা প্রথমে টিকাদানে রাজ্যের সক্রিয় ভূমিকার জন্য গলা ফাটালেও পরে অবস্থান বদল করেছেন।
আজকের ঘোষণার পরে বিজেপি শিবির মোদীকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রচারে নামলেও, নেট-নাগরিকরা বিচারপতি চন্দ্রচূড়কে ধন্যবাদ জানান। আইনজীবীদের বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্ট সক্রিয় হলেই কী ভাবে সরকারকে নড়ে বসতে হয়, তার প্রমাণ মিলল। কারণ কেন্দ্রের নীতির পিছনে কোন যুক্তি কাজ করছে, তা জানতে আদালত সরকারি ফাইল চেয়ে পাঠিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরে আদালতের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে-না ভেবে সরকারি আইনজীবীরাও স্বস্তিতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy