কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামী এবং তাঁর পিতা, দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া। ফাইল চিত্র।
এটাই তাঁর ‘শেষ নির্বাচন’। কর্নাটকে বিধানসভা ভোটের প্রচারে গিয়ে এ কথাই জানিয়েছিলেন জনতা দল (সেকুলার) জেডিএস প্রধান এইচডি দেবগৌড়া। কিন্তু ভোটের ফলাফল বলছে, দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর আবেগঘন আহ্বানেও কাঙ্ক্ষিত সাড়া দেননি ভোটাররা। তাই ভোটের আগে কিংমেকার হওয়ার স্বপ্ন দেখা জেডিএস, এখন কর্নাটকে রীতিমতো অস্তিত্ব সঙ্কটে।
বিভিন্ন বুথফেরত সমীক্ষায় ইঙ্গিত ছিল, কর্নাটক বিধানসভার ফল ত্রিশঙ্কু হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কংগ্রেস বা বিজেপি দুই দলই সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন না পেলে তাদের ত্রাতা হতে পারত দেবগৌড়ার দল। যেমনটা হয়েছিল ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে। সে বার ২২৪ আসনের কর্নাটক বিধানসভায় বিজেপি পেয়েছিল ১০৪টি আসন। অন্য দিকে, কংগ্রেসের ঝুলিতে যায় ৮০টি আসন এবং জেডিএস পায় ৩৭টা আসন। দক্ষিণের এই রাজ্যে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় জাদুসংখ্যা হল ১১৩। বিজেপিকে রুখতে ৫ বছর আগে হাত মিলিয়েছিল কংগ্রেস এবং জেডিএস। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন দেবগৌড়া-পুত্র এইচডি কুমারস্বামী। জেডিএস শিবির আশা করেছিল, এ বারেও তার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। বুথফেরত সমীক্ষাগুলি প্রকাশ্যে আসার পরেই কুমারস্বামী জানিয়েছিলেন, কংগ্রেস না বিজেপি, কাকে তাঁরা সমর্থন করবেন, সে ব্যাপারে তাঁদের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছে। জেডিএস সূত্রে জানা গিয়েছিল, দেবগৌড়ার দলের কাউকেই মুখ্যমন্ত্রী করতে হবে, এই শর্তেই কংগ্রেস বা বিজেপি যে কোনও দলকে সমর্থন দিতে প্রস্তুত ছিল তারা। কিন্তু শনিবার সকালে প্রাথমিক গণনার ফল বেরোনো শুরু হতেই জেডিএস কর্মীসমর্থকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। বেলা গড়াতে সেই ভাঁজ আরও চওড়া হয়েছে। ৩০ থেকে নামতে নামতে ১৯-এ এসে ঠেকেছে জেডিএস-এর আসন।
ভোটপ্রাপ্তির হারের নিরিখে এই নির্বাচনে ‘লোকসান’ হয়েছে কেবল জেডিএস-এরই। কারণ আসনসংখ্যা কমলেও বিজেপির ভোটপ্রাপ্তির হার মোটের উপর একই থেকেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জেডিএস পেয়েছিল ৩৬.২২ শতাংশ ভোট। এ বার তা কিছুটা কমে হয়েছে ৩৬ শতাংশ। কংগ্রেস ৫ বছর আগে পেয়েছিল ৩৮.০৪ শতাংশ ভোট। প্রায় ৫ শতাংশ বেড়ে এ বার তা হয়েছে ৪২.০৯ শতাংশ। অন্য দিকে জেডিএসের ভোট শতাংশ গত বারের (১৮.৩৬ শতাংশ) তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ কমে হয়েছে ১৩.০৩ শতাংশ। পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট যে, জেডিএস-এর ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসিয়েছে কংগ্রেস। কারণ অন্যান্য দলগুলির ভোটপ্রাপ্তির হারেও কোনও বদল ঘটেনি।
জেডিএস কর্নাটকের শক্তিশালী আঞ্চলিক দল হলেও গোটা কর্নাটকে কোনও দিনই তাদের সমান প্রভাব ছিল না। মূলত দক্ষিণ কর্নাটকের পুরনো মাইসুরু অঞ্চলের মধ্যেই সীমিত ছিল জেডিএস-এর ‘প্রতাপ’। দেবগৌড়ারা ভোক্কালিগা জনগোষ্ঠীভুক্ত। কর্নাটকের হিন্দু সমাজ মূলত লিঙ্গায়েত এবং ভোক্কালিগা এই দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত। এর মধ্যে সংখ্যায়, অর্থবলে এবং প্রভাবে খানিক এগিয়ে মূলত ব্যবসায়ী লিঙ্গায়েতরা। লিঙ্গায়েত ভোট বেশ কয়েক বছর ধরেই বিজেপির ভরসার জায়গা। অন্য দিকে ভোক্কালিগাদের মধ্যে প্রভাব ছিল দেবগৌড়াদের। মূলত কৃষিজীবী ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের কিছু ভোট অবশ্য কংগ্রেসের ঝুলিতেও গিয়েছে অতীতে। তবে এ বারের ফল বিশ্লেষণ করে অনেকেই মনে করছেন, জেডিএস-এর ভোক্কালিগা ভোটব্যাঙ্কেও বড়সড় ফাটল ধরেছে। বিজেপি লিঙ্গায়েতদের তুষ্ট করতে, তাদের প্রতি বৈষম্য করছে, কেন্দ্রের শাসকদলের প্রতি ভোক্কালিগাদের এই অভিযোগ নতুন নয়। সেই ক্ষোভকে কংগ্রেস অনেকটাই নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে পেরেছে বলে মনে করা হচ্ছে। আবার ভোক্কালিগাদের মন জয়ে বিজেপিকেও কেম্পেগৌড়ার মতো ঐতিহাসিক চরিত্রের মূর্তি গড়তে দেখা গিয়েছে। তাই ভোক্কালিগা ভোটের অল্প একটা অংশ বিজেপির দিকেও যেতে পারে বলে অনেকের অনুমান।
১৯৯৯ সালে পুরনো জনতা দল ভেঙে জেডিএস গঠন করেছিলেন দেবগৌড়া। ২০০৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ২০.০৮ শতাংশ ভোট পেয়ে ৫৮টি আসনে জিতে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল জেডিএস। ২০১৮ সালে ভোট শতাংশের হার নেমে আসে ১৮ শতাংশে। ২০২৩ সালে তা আরও কমে হয়েছে ১৩.৩১ শতাংশ। ২০১৮ সালে পাওয়া ৩৭টি আসন থেকে এ বার ১৯টি আসন পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে জেডিএসকে। জেডিএস-এর সাফল্যের এই নিম্নমুখী রেখচিত্রের একাধিক ব্যাখ্যা আছে। কেউ কেউ মনে করছেন, কখনও বিজেপি, কখনও কংগ্রেসের সঙ্গী হয়ে শাসকের গদিতে বসা জেডিএস-এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। দেবগৌড়ার দলের বহু জনপ্রতিনিধি পরে বিজেপি বা কংগ্রেসে গিয়ে যোগ দিয়েছেন। তা ছাড়া অন্য দলগুলি বার বার জেডিএস-এর বিরুদ্ধে পরিবারবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে। এ বারেও ভোটের টিকিট বণ্টন নিয়ে কুমারস্বামী এবং তাঁর ভাই এইচডি রেবান্নার বিবাদ প্রকাশ্যে চলে আসে। তা মেটাতে আসরে নামতে হয়ে স্বয়ং দেবগৌড়াকে।
এই নির্বাচনে কুমারস্বামী জিততে পারলেও তাঁর পুত্র নিখিল কুমারস্বামী রামনগর কেন্দ্রে পরাস্ত হয়েছেন। পুত্রের পরাজয় প্রসঙ্গে পিতা জানিয়েছেন, জয় এবং হার দুটোকেই একই মানসিকতা নিয়ে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত তাঁরা। কিন্তু কর্নাটকের রাজনীতির কারবারিরা মনে করছেন, নতুন করে দল এবং সংগঠনকে চাঙ্গা করতে না পারলে রাজ্য রাজনীতির প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হবে জেডিএস। কংগ্রেস এবং বিজেপির দ্বিমুখী লড়াইয়ে ‘কিংমেকার’ হওয়া দূরস্থান, সে ক্ষেত্রে অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াইয়ে নামতে হবে কুমারস্বামীদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy