প্রতীকী ছবি।
পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য অবারিত দ্বার দক্ষিণের এই রাজ্যে। লকডাউন-পর্বেও ‘অতিথি শ্রমিকে’র মর্যাদা দিয়ে শিবির খুলে তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল রাজ্য সরকার। এ বার জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) হাতে সেই পরিযায়ীদেরই তিন জন একেবারে শীর্ষ জঙ্গি সংগঠন আল কায়দার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ধরা পড়ায় আলোড়ন পড়ে গিয়েছে কেরলে। তুঙ্গে রাজনৈতিক তরজাও। বাম-শাসিত কেরলকে ‘সন্ত্রাসবাদী ও দেশদ্রোহীদের নিরাপদ আশ্রয়’ তকমা দিয়ে আসরে নেমে পড়েছে বিজেপি।
বাংলার মুর্শিদাবাদের পাশাপাশি কেরলের এর্নাকুলাম জেলায় একই সঙ্গে হানা দিয়েছিল এনআইএ-র দল। কোচি শহরের উপকণ্ঠে পাঠালাম এবং গ্রামীণ এর্নাকুলামের পেরুম্বাভুর এলাকা থেকে যে তিন জনকে আল কায়দার সন্ত্রাস-চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদেরও আদি বাড়ি মুর্শিদাবাদে। কেরলে গিয়ে তিন জনেই গ্রাসাচ্ছাদনের মতো কাজ নিয়েছিলেন এবং কেউ পরিবারের সঙ্গে, কেউ অন্য পরিযায়ীদের সঙ্গে এক আস্তানায় থাকতেন। তাঁদের সঙ্গে আল কায়দার মতো জঙ্গি সংগঠনের ‘ডার্ক ওয়েব’-এর মাধ্যমে যোগ কী ভাবে হল, ওই সংগঠনের হয়ে টাকা তোলার কাজই বা তাঁরা কোথায় করলেন— এ সব প্রশ্নই তুলছেন বিস্মিত প্রতিবেশী ও পরিচিতেরা। আর তার মধ্যেই বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তাপ!
কেরলে ধৃত তিন জনের মধ্যে মুরশিদ হাসানকে বলা হচ্ছে দলের মাথা। সে রাজ্যের সরকারি ও বেসরকারি সূত্রে যা খবর মিলছে, সেই অনুযায়ী মুরশিদ রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন বিভিন্ন প্রকল্পে। যখন সেই কাজ থাকত না, তখন দিন গুজরানের জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে কিছু না কিছু কাজে হাত লাগাতেন। ভাড়া বাড়ি থেকে এক দল পরিযায়ী শ্রমিককেই তুলে নিয়ে গিয়েছিল এনআইএ এবং তাদের সঙ্গী পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের পরে বাকিদের আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। মুর্শিদাবাদেরই আর এক জন, মোশারফ হোসেনকে ঘুম থেকে গ্রেফতার করেছে এনআইএ। গত সাত বছর ধরে তিনি কাপড়ের দোকানে কাজ করছিলেন। স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে গিয়েছিলেন কয়েক বছর আগে। বাড়ি এবং কাপড়ের দোকানের মালিক, দু’জনেই তদন্তকারীদের বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, মোশারফের কোনও সন্দেহজনক আচরণই তাঁদের কখনও নজরে আসেনি। তৃতীয় জন, ইয়াকুব বিশ্বাস স্থানীয় রেস্তরাঁয় চাপাটি-পরোটা তৈরির কাজ করতেন। পড়াশোনা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। রেস্তরাঁর মালিকের দাবি, কাজের ফাঁকে ইয়াকুব ভয়েস মেসেজ করতেন, ফোনে মেসেজ টাইপ করার সাবলীলতাও তাঁর ছিল না। মুরশিদ, মোশারফ, ইয়াকুবদের ‘জঙ্গি পরিচয়’ বিস্তর ধন্দে ফেলে দিয়েছে আশেপাশের সকলে! নিয়ম মেনে কাজে নেওয়ার সময়ে স্থানীয় পুলিশকে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের সম্পর্কে তথ্যও জানানো হয়েছিল।
আরও পড়ুন: ‘গো়ঁড়া’ সুফিয়ানের পাতালঘর দেখে হতভম্ব প্রতিবেশীরাও
আরও পড়ুন: বাহিনীতে ঢুকে চরবৃত্তির ছক ছিল আতিউরের!
ডার্ক ওয়েব কী?
এক ধরনের ইন্টারনেট ব্যবস্থা যা বিভিন্ন সুরক্ষার একাধিক স্তরে মোড়া থাকে। এই ধরনের ব্যবস্থা ব্যবহার করতে গেলে নির্দিষ্ট ব্রাউজ়ার, সফটওয়্যার দরকার হয়। এক কথায়, নেট দুনিয়ার আঁধার-জগৎ। সাধারণত সার্চ ইঞ্জিন (গুগল, মোজ়িলা) দিয়ে ডার্ক ওয়েবে থাকা ওয়েবসাইটের হদিস মেলে না।
সুরক্ষার কারণ কী?
এনক্রিপশন বা গাণিতিক উপায়ে সাঙ্কেতিক পদ্ধতিতে তথ্যকে মুড়ে রাখা থাকে। ফলে খুব সহজে সেই তথ্য নির্দিষ্ট ব্যক্তির বাইরে কেউ দেখতে পাবে না।
কোন কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়?
টর ব্রাউজ়ার: টর (দ্য আনিয়ন রাউটার) একটি এমন সফটওয়্যার যার মাধ্যমে ব্যবহারকারী নিজের পরিচয় আড়াল করেই তথ্য সুরক্ষাকবচে মুড়ে আদান-প্রদান করতে পারে।
আনিয়ন রাউটিং: সাঙ্কেতিক সুরক্ষা মোড়া তথ্য প্রেরক প্রান্ত থেকে সরাসরি গ্রাহকের কাছে না-পৌঁছে বিভিন্ন প্রান্ত হয়ে ঘুরে ঘুরে যায়। তার ফলে এক বার সুরক্ষা কবচ ভাঙলেও গ্রাহকের হদিস সহজে মেলে না, শুধু পরের গন্তব্য জানা যায়। সেটি থেকে আবার সুরক্ষাবলয় ভেদ করতে পারলে অন্য আর একটি গন্তব্য জানা যায়। পেঁয়াজের মতো একাধিক আস্তরণে ঢাকা থাকে বলে একে ‘আনিয়ন রাউটিং’ বলে।
কী কাজে ব্যবহৃত হয় ডার্ক ওয়েব?
সন্ত্রাসবাদ প্রচারে, বেআইনি আর্থিক লেনদেনে, মাদক ও অস্ত্র কারবারে, বেআইনি পর্নোগ্রাফি ভিডিয়ো বিক্রিতে, নেট জালিয়াতির ক্ষেত্রে।
রাজনীতির পাকে-চক্রে এ সবই অবশ্য শাসক শিবিরের পক্ষে অস্বস্তির কারণ! একে তো সেখানে বাম সরকারের উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী কে টি জলিলকে বিদেশ থেকে অর্থ সাহায্য নেওয়া ও ধর্মীয় প্রচার-পুস্তিকা আনানো সংক্রান্ত অভিযোগে জেরা করেছে এনআইএ। তার উপরে এ বার জঙ্গি সংগঠনের লোক অভিযোগে তিন শ্রমিক গ্রেফতার হয়েছেন। এই সূত্রে বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রে সংসদীয় দফতরের প্রতিমন্ত্রী ভি মুরলীধরনের তোপ, ‘‘পিনারাই বিজয়নের আমলে কেরল সন্ত্রাসবাদী ও দেশ-বিরোধী শক্তির নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছে। উদ্ধত মুখ্যমন্ত্রী সত্য মানছেন না!’’ কেরলের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি মুল্লাপল্লি রামচন্দ্রনের অভিযোগ, ‘‘কোথা থেকে কারা এসে কী ভাবে জঙ্গি-জাল বিস্তার করছে, সেই ব্যাপারে রাজ্য পুলিশ কিছুই জানে না! আইনশৃঙ্খলার এমনই হাল!’’
রাজ্যের মন্ত্রী ও সিপিএম নেতা এ কে বালন অবশ্য বলছেন, ‘‘কেউ অপরাধ করে থাকলে আইন মেনে তার বিচার হবে। কিন্তু বিচ্ছিন্ন ভাবে কেউ কিছু করে থাকলে গোটা রাজ্যকে জঙ্গি ডেরা বলা বা পরিযায়ীদের দিকে আঙুল তোলা আর একটা অপরাধ!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy