Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

সেঙ্গারের নাম শুনলেই মুখে কুলুপ উন্নাওবাসীদের

উন্নাও-রায়বরেলী রোডে কোথায় ঘটেছিল ঘটনাটা? উন্নাওবাসীরা কেউ ‘জানেন না’। অনেকে  তো ‘মনে করতে’ পারলেন না।

নির্যাতিতার বাড়ির সামনে সিআরপি জওয়ানেরা। —নিজস্ব চিত্র।

নির্যাতিতার বাড়ির সামনে সিআরপি জওয়ানেরা। —নিজস্ব চিত্র।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
উন্নাও শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:১৯
Share: Save:

না, জানি না তো!

এ রকম ঘটনার কথা শুনিনি!

হ্যাঁ, হয়েছিল। কিন্তু কোথায় জানি না।

বিহার রোড থেকে লালগঞ্জ পেরিয়ে উন্নাও-রায়বরেলী রোডে এসে উঠেছি। উন্নাও থেকে রায়বরেলীর দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার। আশ্চর্য সমাপতন এই যে, উন্নাওয়ের দু’-দু’টি ধর্ষণ মামলার সঙ্গেই রায়বরেলী যাওয়ার রাস্তাটা যুক্ত হয়ে আছে। রায়বরেলী আদালতে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে গ্রামের মোড়েই আক্রান্ত হন ভাটানখেড়ার মেয়েটি। ঠিক চার মাস আগে রায়বরেলীর জেলে কাকার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পথেই ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা ‘খেয়েছিল’ অন্য মেয়েটির গাড়ি। মরতে মরতে বেঁচেছেন নির্যাতিতা নিজে, তাঁর আইনজীবী মহেন্দ্র সিংহ। মারা গিয়েছেন নির্যাতিতার কাকিমা আর কাকিমার বোন। উন্নাওয়ের কুলদীপ সেঙ্গার মামলার অন্যতম মাইলফলক এই ‘দুর্ঘটনা’।

উন্নাও-রায়বরেলী রোডে কোথায় ঘটেছিল ঘটনাটা? উন্নাওবাসীরা কেউ ‘জানেন না’। অনেকে তো ‘মনে করতে’ পারলেন না। উন্নাও-পীড়িতার কথা উঠলে সবাই ভাটানখেড়ার রাস্তা দেখাতে আগ্রহী। কুলদীপ মামলার কথা তুললেই মুখে কুলুপ। উত্তরপ্রদেশ উন্নাও নিয়ে কথা বলছে বটে, কিন্তু খোদ উন্নাওবাসীরা সেঙ্গার ভাইদের প্রসঙ্গ নিয়ে ‘স্পিকটি নট’। সামনের ১৬ তারিখ কুলদীপের একটি মামলার রায় বেরোতে চলেছে। তবু কথা নেই। কী করেই বা থাকবে? ট্রাক-গাড়ি সংঘর্ষের এক প্রত্যক্ষদর্শী মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। কিছু দিন আগে তাঁর গাড়িও ট্রাকেই ধাক্কা ‘খেয়েছে’। মরেননি, জখম হয়েছেন।

আরও পড়ুন: বিক্ষোভের আগুন অসমে এতটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ছড়াবে, ভাবেননি অমিত শাহেরা

অথচ কুলদীপ মামলা শিরোনামে ফিরে এসেছিল অগস্ট মাসের ওই পথ ‘দুর্ঘটনাকে’ কেন্দ্র করেই। এর পরেই কুলদীপকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়, কাগজেকলমে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মামলা দিল্লিতে সরে যায়। নির্যাতিতার পরিবারও দিল্লি চলে যায়। এরই মধ্যে প্রায় নিঃশব্দেই ওই সংঘর্ষের ঘটনায় কুলদীপের বিরুদ্ধে কিন্তু খুনের চার্জ না দিয়ে মামলা সাজাচ্ছে সিবিআই।

রায়বরেলী জেলায় ঢুকে উন্নাও-রায়বরেলী রোডে একটা ধাবায় বসে কথা হচ্ছিল। জায়গাটা যে ওরই আশেপাশে, জানা ছিল। ধাবার কর্মীকে প্রশ্ন করায় তিনি দাবি করলেন, ছ’মাসের মধ্যে এ রাস্তায় নাকি দুর্ঘটনাই ঘটেনি। তাই? ধাবার পাশেই পানের দোকান। এক রুদ্রাক্ষধারী পান সাজছেন। ধাবাটা আদতে ওঁরই। পানের খুব প্রশংসা করায় চারদিক দেখে নিয়ে সতর্ক গলায় বললেন, ‘‘আর একটু এগিয়ে গেলে কাঠের দোকান পড়বে। তার পরের যে ধাবা, ওর সামনে ঘটনাটা ঘটে।’’ যাওয়া গেল। সেই ধাবার কর্মী সৌভাগ্যবশত মনে করতে পারলেন। বললেন, ‘‘ট্রাকটা বিপজ্জনক ভাবে ছুটে আসছে দেখে গাড়িটা রাস্তা থেকে নেমে বাঁ দিকে সরে গিয়েছিল। নম্বরপ্লেট কালো করা ট্রাক ঠিক ততটাই সরে গিয়ে গাড়িটাকে মারে।’’

এই ‘নিছক দুর্ঘটনা’ই যদিও কুলদীপের আস্তানা, মাখি গ্রামের পাহারায় রাজ্য পুলিশকে সরিয়ে সিআরপিএফ জওয়ান মোতায়েন করিয়েছে। গত মার্চ মাসে নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিলাম। মাখিতে তখন সংবাদমাধ্যমের পা পড়ত না। এখন ভাটানখেড়ার ঘটনা এবং কুলদীপের বিরুদ্ধে একটি মামলার রায় বেরনোর সম্ভাবনায় মাখি গ্রাম মিডিয়ার নজরে রয়েছে। সেঙ্গারদের প্রাসাদ লাগোয়া যে ভাঙাচোরা বাড়িতে মেয়ের মা অন্য তিন সন্তানকে নিয়ে ত্রস্ত হয়ে বাস করছিলেন, সে বাড়িতে এখন তালা।

পাহারায় থাকা জওয়ানদের মধ্যে রয়েছেন বর্ধমানের সুকুমার হাজরা। এক গাল হেসে তিনিই চিনিয়ে দিলেন উকিল মহেন্দ্র সিংহের বাড়ি। সে বাড়ির সামনেও মোতায়েন সিআরপি। মহেন্দ্র দিল্লিতে চিকিৎসাধীন। বাক্শক্তি ফেরেনি। বাবা-মা-স্ত্রীও দিল্লিতে। বাড়িতে দেখা হল তাঁর বোনের সঙ্গে। কথা বলতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন না। বললেন, ‘‘ন্যায়বিচারের আশায় আছি। আর কিছু বলব না।’’ আগল ভাঙল ‘দুর্ঘটনাস্থলটা’ দেখে এসেছি জানার পর। ‘‘আপনি গিয়েছিলেন? বলুন তো, ইচ্ছে করে না মারলে ওই রকম ঘটে? এখানে সবাই তো সেঙ্গারের গোলাম! বাচ্চাদের ডেকে জিজ্ঞেস করুন, দেখবেন তারাও সেঙ্গারের গুণগান করছে!’’

উন্নাওয়ে ঘুরলে স্পষ্ট বোঝা যায়, মাখি গ্রামের মামলা শুধু অপহরণ-ধর্ষণ-খুন-খুনের চেষ্টার মামলা নয়। মামলার এক থেকে একশো, ঠাকুর কুলদীপ সিংহ সেঙ্গার। কুলদীপ শুধু বিধায়ক নয়, কুলদীপ শুধু বিজেপির (এখন খাতায়কলমে বহিষ্কৃত) নয়। কুলদীপ, আর তার দুই ভাই, অতুল-মনোজ এবং তাদের দলবলের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া জেলায় গাছ থেকে পাতাও পড়ে না। রাজনীতি-অর্থনীতি, শিল্পপতি-কৃষিপতি, যিনি যা-ই হন, সেঙ্গারদের বাদ দিয়ে নয়। কুলদীপ-অতুল জেলে। মনোজ সম্প্রতি মারা গিয়েছে। তা-ও আতঙ্ক কমেনি। দু’মাসেরও বেশি এই গ্রামে রয়েছেন জওয়ানেরা। ওঁরাও বুঝে গিয়েছেন, ‘কুলদীপরা এ তল্লাটের রাজা। পুলিশও তাদের কথাতেই ওঠেবসে।’ এক জন বললেন, ‘‘এই আপাত শান্ত চুপচাপ গ্রাম দেখে কোনও ধারণা করবেন না। রায় বেরনোর পরে যে কোনও মুহূর্তে বড় ধরনের হাঙ্গামা হতে পারে। আরও চার কোম্পানি সিআরপিএফ তাই উন্নাও সদরে প্রস্তুত হয়ে রয়েছে।’’

সেঙ্গারের বাড়ির দরজাটা অল্প খোলা। বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে শিবমন্দিরটা। মনে পড়ল, মার্চ মাসে নির্যাতিতার মায়ের মুখে শুনে যাওয়া কথাগুলো। ‘‘অতুল সেঙ্গার লোক পাঠিয়ে মেয়ের বাবাকে ঘর থেকে টেনে নিয়ে গেল দিদি। মন্দিরের পাশে একটা নিমগাছ আছে। ওই গাছে বেঁধে ট্রাক্টর দিয়ে জল ছেড়ে দিল। তার পর বন্দুকের নল দিয়ে কুঁদে কুঁদে মেরে ফেলল...।’’ শিবের উপাসক বলে অতুলকে আড়ালে আজও ‘মহাকাল’ বলে ডাকেন স্থানীয়েরা।

ভক্তিতে নয়, হাড় হিম করা ভয়ে।

অন্য বিষয়গুলি:

Crime Unnao Rape Murder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy