তয়াবুন ও জুলেখা । নিজস্ব চিত্র
একটা আংটি। কতই বা ওজন? ১০ গ্রাম! কিন্তু আংটির ওজন তো আর ধাতুর ওজনমাত্র নয়। একটা অভিজ্ঞান-অঙ্গুরীয় হারিয়ে ফেলায় নাজেহালের অন্ত ছিল না শকুন্তলার। অরণ্যদেবের খুলিচিহ্নের আংটি, প্রিন্সেস ডায়ানার আঙুলে একদা শোভিত ১৮ ক্যারেট হিরে ও নীলার আংটি, রাজা সলোমনের আংটি থেকে পোপের অনামিকায় থাকা ফিশারম্যান রিং— এ সবের দাম কি স্বর্ণকারের দাঁড়িপাল্লা নির্ধারণ করতে পারে? সত্যজিতের বাদশাহি আংটি বা শীর্ষেন্দুর হীরের আংটিরা বাংলা সাহিত্যের মণি-মাণিক্য। আংটির গুরুত্ব আসলে নিছক ক্যারেট-ভরির হিসেবে নয়, গুরুত্ব আংটির মধ্যে থাকা আঙুল আর আংটির ইতিহাসে। তাই তো ডিসকাস, শট-পাট ছোড়ায় দক্ষ তয়াবুন নিসা এত বছর ধরে একটা হালকা আংটির স্মৃতি মন থেকে ছুড়ে ফেলতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত একটা খাম আর বান্ধবীর আলিঙ্গনে গত ৫৬ বছরের শাপমুক্তি!
জাতীয় স্তরে মেডেল জেতা অসমের প্রথম মহিলা অ্যাথলিট তয়াবুন নিসা পরে আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতি পান। তিনিই উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলে খেলোয়াড় কোটায় চাকরি পাওয়া প্রথম মহিলা। জীবনের অনেক উত্থান-পতনের মধ্যেও তয়াবুন ১৯৬৭ সালে, স্কুলজীবনে ঘটা একটা ঘটনা মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি।
তিনি বলছিলেন, “তখন শিবসাগরের ধাই আলি গার্লস হাইস্কুলের সেভেনে পড়ি। বান্ধবী জুলেখা ছিল বেশ স্বচ্ছল ঘরের মেয়ে। স্কুলে সোনার আংটি পরে আসত। এক দিন সেই আংটি গেল হারিয়ে। কোথাও আংটি খুঁজে না পেয়ে কাঁদো কাঁদো জুলেখা বাড়ি ফিরে গেল। আমি সাধারণত খেলাধুলো করতে আগেই স্কুলে পৌঁছতাম। তাই ক্লাসরুমের চেয়ার-টেবিল ঠিকঠাক করার ভারও আমারই ছিল। পরের দিন সেই কাজ করতে গিয়েই আংটিটা খুঁজে পেলাম! কিন্তু ভাবলাম, এখন আমি আংটি ফেরত দিতে গেলে তো আমাকেই সবাই চোর ভাববে। সেই ভয়ে আংটি নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। আমাদের দরিদ্র পরিবারে বাবার মৃত্যুর পরে সম্ভবত আত্মীয়রা ওই আংটিও বিক্রি করে দিয়েছিলেন।”
পরে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে অনেক জল বয়ে যায়। খেলা, রেলের চাকরির সৌজন্যে গ্রাম থেকে দূরে চলে যান তয়াবুন। বহু জায়গা ঘোরেন। জাতীয় মহিলা ডিসকাস চ্যাম্পিয়ন হন। কিন্তু মন থেকে সেই আংটির ভার কখনও নামেনি।
তিনি বলেন, “লজ্জায় যে ঘটনা বলতে পারিনি, তার প্রায়শ্চিত্ত কোনও ভাবে করতেই হবে ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু জুলেখাও তত দিনে বড় হয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছে। আমার বোন অনেক কষ্টে জুলেখার নম্বর জোগাড় করে দেয়। কয়েক দশক পরে আমাদের ফের কথা শুরু হয়। কিন্তু কথা বলতে গিয়েও আংটির কথা মুখ দিয়ে বেরোচ্ছিল না সঙ্কোচে। বার বার বলতাম এক দিন তোর বাড়ি যাবই।” শেষ পর্যন্ত হাতের খামে ১২ হাজার টাকা ঢুকিয়ে গুয়াহাটির মালিগাঁওয়ের বাড়ি থেকে শিবসাগরে কুকুরাপুহিয়ায় থাকা বান্ধবীর বাড়ি হাজির হন তয়াবুন। সাড়ে পাঁচ দশকেরও বেশি ব্যবধানে, সত্তরোর্ধ্ব দুই বান্ধবী একে অন্যকে সামনে পেয়ে আবেগে ভাসতে থাকেন। মনে বহু সঙ্কোচ নিয়ে শেষ পর্যন্ত আংটির কথা পাড়েন তয়াবুন। কিন্তু জুলেখা সেই স্মৃতি কবেই ভুলেছেন।
তবু নাছোড় তয়াবুন বান্ধবীর হাতে জোর করে তুলে দেন ক্ষতিপূরণের মূল্যবাবদ টাকার খাম। বলেন, “এ আমার প্রায়শ্চিত্ত। এত বছরের গ্লানি। এটুকু না নিলে মরেও যে শান্তি পাব না।” বান্ধবীর হাত চেপে ধরে জুলেখা বলছিলেন, “আমার কিছুই মনে ছিল না। এখন ভাবছি, ভাগ্যিস আংটিটা হারিয়েছিল, তাই তয়াবুন কিছুতেই পুরনো বান্ধবীর টান ভুলতে পারেনি। বন্ধুত্বের এই যে টান, সেটাই তো পরশপাথর।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy