সুপ্রিম কোর্ট। —ফাইল চিত্র।
নাগরিকত্ব আইনের ৬এ ধারা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অসমে আসা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হলেও কেন পশ্চিমবঙ্গে আসা শরণার্থীদের বাদ দেওয়া হল— জানতে চাইল সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ। প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় প্রশ্ন করেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের যখন অনেক বেশি লম্বা সীমান্ত রয়েছে, শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য কেন অসমকে বেছে নেওয়া হল?”
প্রধান বিচারপতি বলেন, “শরণার্থী সমস্যা শুধু সংস্কৃতিতে সঙ্কট আনে না, রাজ্যের সম্পদের উপরেও চাপ সৃষ্টি করে। কোথাও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে বলে সেখানে এক রকম ব্যবস্থা হয়েছে, অন্য জায়গায় সেই সুবিধা দেওয়া হল না— এটা মেনে নেওয়া যায় না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সবার জন্য সমান অধিকারই হওয়া উচিত।” তাঁর কথায়, “এমন কোনও তথ্য আছে কি যে, পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশের সংখ্যা নগণ্য তাই আমরা শুধু অসম নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি? পশ্চিমবঙ্গ কী ভাবে অবৈধ শরণার্থীদের সমস্যা সামলাচ্ছে?”
দেশ ভাগের পরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহু শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ত্রিপুরায় চলে আসেন। কিছু সমীক্ষার হিসাব অনুযায়ী এই সংখ্যাটি এক কোটিরও বেশি। সব চেয়ে বেশি শরণার্থী এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু সকলেই বাংলা ভাষাভাষী হওয়ায় এ দেশে সংস্কৃতির সংঘাতটি অসমিয়া অধ্যুষিত অসমের মতো তীব্র হয়নি। কিন্তু ‘অসম চুক্তি’-র পরে অসমে যাওয়া শরণার্থীদের একাংশকে কেন্দ্র নাগরিকত্বের সুবিধা দেওয়ায় প্রশ্ন তোলেন বাংলার শরণার্থীরা। মতুয়া সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা তাঁদের সম্প্রদায়ের লোকেদের নাগরিত্বের দাবিতে আন্দোলন করছেন। গোটা পশ্চিমবঙ্গে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হলেও মতুয়ারা এই আইনের পক্ষে শুধু পথেই নামেননি, ঢেলে ভোট দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপিকে। তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবির পক্ষে মতুয়ারা বারে বারে ‘অসম চুক্তি’ এবং ৬এ ধারার প্রসঙ্গ তুলেছেন।
নাগরিকত্ব আইনের ৬এ ধারার সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে অসমের কিছু সংগঠন যে মামলা করেছে, তার শুনানিতেই প্রসঙ্গক্রমে পশ্চিমবঙ্গের অনুপ্রবেশ পরিস্থিতি উঠে এসেছে সর্বোচ্চ আদালতে। বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশ মোকাবিলায় কেন্দ্র কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা-ও সবিস্তার জানতে চেয়েছেন বিচারপতিরা। হলফনামা দিয়ে কেন্দ্রকে এই সব তথ্য জানাতে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আজ ছিল মামলার তৃতীয় শুনানি।
কেন্দ্রের তরফে সওয়াল করা সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতাকে আজ প্রধান বিচারপতি বলেন, নাগরিকত্ব আইনের ৬এ ধারা অনুযায়ী ১৯৬৬-র ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসমে অনুপ্রবেশ করা বাংলাদেশিদের নাগরিকত্বের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কত জন এই সুবিধা পেয়েছেন এবং কত জন পাননি, তাঁদের ক্ষেত্রে সরকার কী পদক্ষেপ করেছে, তা হলফনামায় জানাতে হবে। ১৯৭১-এর পরে অনুপ্রবেশ পরিস্থিতি কেমন, তা-ও জানাতে হবে। জবাবে মেহতা যুক্তি দেন, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে অনুপ্রবেশের ফলে অসমিয়া সংস্কৃতি ও ভূমিপুত্রের অধিকার নিয়ে সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ায় অসমে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সে জন্য কেবল মাত্র অসম রাজ্যের জন্যই নাগরিকত্ব আইনের ৬এ ধারাটি তৈরি করা হয়েছিল। ২০১৩-র পরে সেটি আর কার্যকর নেই। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশে রূপান্তরিত হওয়ার পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ঘোষণা করেছিলেন, ১৯৭১-এর পরে দেশ ছেড়ে যাওয়া সবাইকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। সেই জন্যই ৬এ ধারায় ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য ১৯৭১-এর ২৫ মার্চকে বেছে নেওয়া হয়, কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ।
প্রধান বিচারপতির মন্তব্য— “আমরা কোনও স্বৈরাচারী দেশে নেই। একটা গণতান্ত্রিক দেশে আইনের শাসন মেনে চলতে হয়। সেটা না হলে বৈধ বাসিন্দাদেরও ধরে দেশের বাইরে বার করে দেওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে।”
অসমে অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পরে ১৯৮৫-তে ভারত সরকার এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে হওয়া ‘অসম চুক্তি’-র অঙ্গ হিসাবে নাগরিকত্ব আইনের ৬এ ধারা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এই মামলার আবেদনকারীদের বক্তব্য— ‘অসম চুক্তি’-কে ২৫৩ ধারার অধীনে বৈধতা দেওয়ার জন্য কোনও পদক্ষেপ করেনি সংসদ। সুতরাং অসম চুক্তিরই বৈধতা নেই। শুনানিতে অংশ নিয়ে আবেদনকারীদের আইনজীবী কে এন চৌধরি বলেন, “দ্বৈত নাগরিকত্ব ভারতে বৈধ নয়। কিন্তু ৬এ ধারায় নাগরিকত্ব পাওয়া ব্যক্তিদের কেউ তাঁদের পূর্বতন দেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করার মুচলেকা জমা দেননি। সেই অর্থে তাঁরা এখনও দুই দেশের নাগরিক। রাজনৈতিক স্বার্থে করা নাগরিক আইনের বিশেষ এই ৬এ ধারার ফলশ্রুতিতে ভারত সরকার নিজের নাগরিকদের মূল্যে শরণার্থীদের সুরক্ষা দিচ্ছে!”
বুধবার শুনানির দ্বিতীয় দিনে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় মন্তব্য করেছিলেন, “অসম আন্দোলনের উত্তাল পরিস্থিতি সামলাতে ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে অত্যাচারিত শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে সংসদ যা উচিত মনে হয়েছিল করেছে। শরণার্থীর বোঝা বহন করতে ও তাঁদের নাগরিকত্ব দিতে বাধ্য নয় সংসদ।” এর জবাবে আবেদনকারীদের আইনজীবীরা বলেছিলেন, “বাস্তব পরিস্থিতি ও ফলশ্রুতি বিবেচনা না করে যে ভাবে ৬এ ধারা প্রণয়ন করা হয়েছে, তা হঠকারী ও অসাংবিধানিক। তিব্বতি, চাকমা, তামিল ও রোহিঙ্গাদের জন্যও কেন্দ্রের শরণার্থী নীতি রয়েছে। কিন্তু কোনও নীতিতেই শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয় না, যা অসমে করা হয়েছে।”
প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি সূর্য কান্ত, বিচারপতি এম এম সুরেশ, বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্র। যে সব প্রশ্ন সর্বোচ্চ আদালত করেছেন, সোমবার ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে হলফনামা দাখিল করে তার জবাব দিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতিরা। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে জবাব দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সলিসিটর জেনারেল মেহতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy