—প্রতীকী চিত্র।
২২ বছর আগের সেই বিভীষিকা আর ক্ষত আজও দগদগে! চোখের সামনে সে দিন বাড়ির ১৪ জনকে নৃশংস ভাবে খুন করেছিলেন হামলাকারীরা। তিন বছরের মেয়েকেও পাথরের উপর আছড়ে মেরে ফেলেছিলেন। তার পর পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা তরুণী মাকে গণধর্ষণ! ২০২২ সালের ১৫ অগস্ট, আজাদির অমৃত মহোৎসবের দিনে সেই ধর্ষক এবং হত্যাকারীরা জেল থেকে মুক্তি পাওয়ায় মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন বিলকিস বানো। অস্ফুটে যতটুকু বলতে পেরেছিলেন, তার নির্যাস ছিল, ‘‘এক জন মহিলার প্রতি ন্যায়বিচার এই ভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে?’’ সে দিন ন্যায়ের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে নিরাশা গ্রাস করেছিল বিলকিসকে। সোমবার তাঁর স্বস্তি পাওয়ার দিন। কারণ, যে ১১ জন অপরাধীকে মুক্তি দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল গুজরাত সরকার, তা খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। অর্থাৎ, অপরাধীদের আবার ফেরত যেতে হবে জেলে।
২০০২ সাল। গোধরাকাণ্ড পরবর্তী গুজরাত তখন হিংসার আগুনে জ্বলছে। সাবরমতী এক্সপ্রেসে অগ্নিকাণ্ডের জেরে ৫৯ জন করসেবক এবং পুণ্যার্থীর মৃত্যুর ঘটনার পরেই শুরু হয়েছিল সেই সাম্প্রদায়িক হানাহানি। সেই সময় বিলকিসের বয়স ছিল ২১। দাহোড় জেলার রাধিকপুর গ্রামে থাকতেন। গোধরাকাণ্ডের আগে থেকেই অবশ্য ওই গ্রামে হিংসার আবহ তৈরি হয়েছিল ইদের সময় একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। গোধরার ঘটনার পর তা আরও তীব্র হয়। আতঙ্কে তিন বছরের শিশু কন্যা আর জনা পনেরো আত্মীয়ের সঙ্গে গ্রাম ছেড়েছিলেন বিলকিস। সেই সময় তিনি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ছাপাড়ভাড় জেলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন বিলকিস এবং তাঁর পরিবার। সঙ্গে ছিলেন তাঁর মা ও বোন। সেখানেই তাঁদের উপর হামলা হয়। কাস্তে, তরোয়াল, লাঠি হাতে জনা কুড়ির একটি দল বিলকিসের গোটা পরিবারকে হত্যা করে। ধর্ষণ করা হয় বিলকিস ও তাঁর মা, বোনকে। চোখের সামনে মেয়েকে খুন হতে দেখেছিলেন বিলকিস। নির্মম অত্যাচারে সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন নিজেও। পরে জানা যায়, রাধিকপুর গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা বিলকিসদের দলের আট জনের দেহ উদ্ধার হয়েছিল। জীবিত ছিলেন বিলকিস ও এক শিশু। এক আদিবাসী মহিলা বিলকিসকে উদ্ধার করেছিলেন। এর পর এক হোমগার্ডের সাহায্য নিয়ে লিমখেরা থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন ধর্ষিতা সেই তরুণী। থানা থেকে গোধরা ত্রাণ শিবিরে পাঠানো হয়েছিল বিলকিসকে। তার পর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তাঁর মেডিক্যাল পরীক্ষা করানো হয়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বিলকিসের বিষয়টি নিয়ে লড়াই শুরু করে। হস্তক্ষেপ করে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই বিলকিস গণধর্ষণের তদন্তে নামে সিবিআই। তদন্ত করে সিবিআই জানিয়েছিল, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে গোটা ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। অভিযুক্তদের বাঁচাতেই তৈরি হয়েছিল রিপোর্ট। ঘটনার ভয়াবহতায় চমকে উঠেছিলেন কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তকারীরাও। তাঁরা জানিয়েছিলেন, বিলকিসের আত্মীয়দের এমন ভাবে খুন করা হয়েছিল যে, পরে শনাক্তও করা যায়নি। মামলা ওঠে গুজরাটের আদালতে। ২০০৪ সালে বিলকিস সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। অভিযোগ করেছিলেন, প্রাণনাশের হুমকি পাচ্ছেন। গত দু’বছরে ২০টি বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে তাঁকে। ২০০৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মুম্বইয়ের আদালতে সরানো হয় বিলকিসের মামলা। ১৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ছ’জন পুলিশ অফিসার এবং এক জন সরকারি চিকিৎসক। ২০০৮ সালের ২১ জানুয়ারি ১২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত। প্রমাণের অভাবে বাকি সাত জন বেকসুর খালাস পান। পরে শুনানি চলাকালীন এক অভিযুক্তের মৃত্যু হয়।
শুনানি চলাকালীন প্রত্যেক অভিযুক্তকেই শনাক্ত করেছিলেন বিলকিস। জানিয়েছিলেন, অভিযুক্তেরা সকলেই তাঁর পরিচিত। গত কয়েক বছর ধরে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের থেকে দুধ কিনতেন অপরাধীরা। ২০১৭ সালের মে মাসে বম্বে হাই কোর্ট ১১ জন ধর্ষকের যাবজ্জীবন সাজা বহাল রাখে। ২০১৯ সালে গুজরাত সরকারকে বিলকিসের হাতে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয় সু্প্রিম কোর্ট। এর পর ২০২২ সালে বিলকিসের ধর্ষকদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় গুজরাত সরকার। তাঁদের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দিতে দেখা যায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে। যা নিয়ে তুমুল বিতর্কও হয়।
এ সব দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন বিলকিস। বলেছিলেন, ‘‘আমি তো শীর্ষ আদালতে বিশ্বাস রেখেছিলাম, সিস্টেমে বিশ্বাস রেখেছিলাম, একটু একটু করে আমার ক্ষতগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে শিখছিলাম। দোষীদের মুক্তি আমার শান্তি ছিনিয়ে নিল, ন্যায়ের প্রতি আমার বিশ্বাস নড়ে গেল। আমি শুধু আমার কথা বলছি না। প্রতিটি মেয়ে যারা আদালতে ন্যায়ের জন্য লড়ছে, তাদের সকলের জন্য কষ্ট হচ্ছে আমার।’’ সোমবার সুপ্রিম কোর্ট গুজরাত সরকারের সেই সিদ্ধান্তকে বাতিল করল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy