Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
গ্যাস নিয়ে গবেষণাই হল না, ফর্মালিনে না-ফোটা জীবন
Bhopal Gas Tragedy

ফর্মালিনে রয়েছে না-ফোটা জীবন

চল্লিশ বছর আগের সব ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে আছে বছর পঁচাত্তরের ওই ফরেন্সিক চিকিৎসকের। বর্তমানে যিনি এল এন মেডিক্যাল কলেজ ভোপালের ‘ডিন অব স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার’।

গ্যাস-কাণ্ডের শিকার। ভোপাল নিয়ে চলছে ছবি প্রদর্শনী।

গ্যাস-কাণ্ডের শিকার। ভোপাল নিয়ে চলছে ছবি প্রদর্শনী। —নিজস্ব চিত্র।

জয়তী রাহা
ভোপাল শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৪:৪৮
Share: Save:

ভোপালের হামিদিয়া হাসপাতালের কলেজ ল্যাবে কাচের বোতলের ফর্মালিনে ডুবে রয়েছে ৩০টির মতো আলো দেখতে না পাওয়া ভবিষ্যৎ। যারা তাদের ভূমিষ্ঠ হতে দেয়নি, তাদের শাস্তি না হওয়ায় তাই আজও চোখের জল ফেলেন চিকিৎসক দিব্যকিশোর শতপথী। ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানার সব থেকে কাছের হামিদিয়া সরকারি হাসপাতালের (বর্তমানে বেসরকারি) তৎকালীন ফরেন্সিক চিকিৎসক তিনি।

চল্লিশ বছর আগের সব ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে আছে বছর পঁচাত্তরের ওই ফরেন্সিক চিকিৎসকের। বর্তমানে যিনি এল এন মেডিক্যাল কলেজ ভোপালের ‘ডিন অব স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার’।

খবর ছড়িয়েছিল, বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাসের ছোবলে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছেন কাতারে কাতারে মানুষ। ভোপাল গ্যাস লিক দুর্ঘটনার ২৪ ঘণ্টারও বেশি পরে জানা যায়, ‘লিক’ হওয়া সেই রাসায়নিক গ্যাসের নাম মিথাইল আইসোসায়ানেট (এমআইসি)। তবে শুধু এমআইসি-ই সেই রাতে ‘লিক’ হয়েছিল, এমন কথা আজও মানেন না শতপথী।

১৯৮৪ সালের ৩ ডিসেম্বর ভোরে তাঁর বিভাগীয় ডিরেক্টর হীরেশ চন্দ্রার ডাকে বছর পঁয়ত্রিশের দিব্যকিশোর পৌঁছে যান হাসপাতালে। মৃতদেহের সারি আর ধুঁকতে থাকা মানুষের ভিড় ঠেলে বিভাগে পৌঁছন। তিন চিকিৎসককে নিয়ে নেমে পড়েন ময়না তদন্তে। টানা ২৪ ঘণ্টায় ৮৭৬ জন গ্যাসে মৃত দেহের ময়না তদন্ত করে চার চিকিৎসকের দল। শবের ভিড় সামলাতে একটানা ৭২ ঘণ্টা চলে ময়না তদন্ত। চার চিকিৎসকই এর পরে অসুস্থ হন। অ্যাজ়মায় আক্রান্ত চার জনকেই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত চিকিৎসায় থাকতে হয়।

এ হেন অভিজ্ঞতার সাক্ষী শতপথীর মতে, কোনও একটি নয়, একাধিক রাসায়নিক গ্যাসের উপস্থিতি এবং পরস্পরের বিক্রিয়াই ভোপালে গ্যাস লিক পরবর্তী পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছিল। তাঁর আফশোস, ভোপালে নির্গত রাসায়নিক গ্যাসের চরিত্র নিয়ে গবেষণা হল না। ফলে ভবিষ্যতে যদি এমন বিপর্যয় ঘটে, তা মোকাবিলার প্রস্তুতি হল না। পিছিয়ে গেল চিকিৎসাবিজ্ঞানও।

চিকিৎসকের ব্যাখ্যা, ওই ঘটনায় অসংখ্য রাসায়নিক গ্যাস নির্গত হয়ে পরিবেশে ছড়াচ্ছিল। সবগুলিই যে বিষাক্ত, এমন নয়। কারও প্রভাব থাকছিল ১০০ মিটার, কারও ৫০০ মিটার, কারও এক কিলোমিটার পর্যন্ত। কোন গ্যাস কতটা দূরত্ব পার করছে, তাকে চিহ্নিত করে এবং চরিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে বলা যেত, কোনটি শরীরের কোন অঙ্গের ক্ষতিসাধন করতে পারে। এবং ক্ষতি প্রতিরোধ কী ভাবে সম্ভব, ভাবা যেত। দিব্যকিশোরের আফশোস, “চিহ্নিত করার উপায়ও বলেছিলাম। কেউ গুরুত্ব দেননি। কোনও নির্দিষ্ট এলাকাকে ঘিরে রেখে সেই কাজ হতে পারত। পর্যাপ্ত সতর্কতা নিয়ে, দু’-তিন কেজি এমআইসি সংগ্রহ করে তার উপরে জল ঢেলে কিছু সময় অন্তর বিক্রিয়ায় নির্গত গ্যাস সংগ্রহ করা যেতে পারত। যা পর্যবেক্ষণ করে গবেষণায় বোঝা যেত, কোন রাসায়নিক পরিবর্তন হচ্ছে, তা কী ভাবে মানবশরীরকে প্রভাবিত করতে চলেছে। চিকিৎসা হত সেই অনুযায়ী।”

তার বদলে অচেনা পরিস্থিতির সামনে নিরুপায় চিকিৎসকেরা প্রথমে গ্যাস-আক্রান্তের উপসর্গ দেখেই চিকিৎসা শুরু করেছিলেন। ঘটনার পরেই জানা যায়নি গ্যাসের চরিত্র। “এমআইসি লিকের কথা জানতেই বোঝা গেল, মানবশরীরে সায়োনেট ঢুকছে। তখন সোডিয়াম থায়োসালফেট দেওয়ার সিদ্ধান্ত সরকারি স্তরে বাধ্যতামূলক হয়। কারণ, সোডিয়াম থায়োসালফেট শরীরে গিয়ে সায়োনেটের সঙ্গে মিশে বিষহীন সোডিয়াম থায়োসায়নেটে পরিণত হয়। যা মূত্রের সঙ্গে বেরিয়েও যায়। পরীক্ষায় তা প্রমাণিত। অথচ এক অজানা কারণে তিন দিন পরে নোটিস দিয়ে মত বদলায় প্রশাসন। সোডিয়াম থায়োসালফেট তখন আর বাধ্যতামূলক না থাকায়, তা অনেকেই পেলেন না। তা না হলে আরও জীবন বাঁচানো যেত।” আক্ষেপের সুর ঝরছিল দিব্যকিশোরের কথায়।

প্রশাসন ও চিকিৎসা গবেষণায় যুক্ত সংস্থার উদাসীনতাও ভাবায় ওই চিকিৎসককে। গ্যাস-আক্রান্তদের শরীর থেকে টিসু এবং রক্তের নমুনা দীর্ঘ ২০ বছর সংগ্রহ করে রেখেছিলেন তাঁরা। নয়াদিল্লির আইসিএমআর, গুজরাত ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাব, কানপুর টক্সিকোলজি সেন্টার, মেডিকো লিগাল ইনস্টিটিউট ভোপাল তাদের গবেষণায় সেই টিসুর ব্যবহার করে প্রাপ্ত তথ্য লিপিবদ্ধও করেছে। টিসু ও রক্তের ওই সব নমুনা পরবর্তী সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাছে চিঠি লিখে আবেদন করেন চিকিৎসক। কিন্তু সরকার এবং গবেষণা সংস্থা আগ্রহ দেখায়নি। এ দিকে গোটা এক দিন হামিদিয়া হাসপাতালে লোডশেডিং থাকায় ৫০ শতাংশ সংগৃহীত টিসু নষ্ট হয়ে যায়। তখন সে সব ফেলে দিতে বাধ্য হন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাঁর অভিযোগ, ইউনিয়ন কার্বাইডের মিথ্যে দাবি ক্ষতি করেছে পরবর্তী প্রজন্মেরও। কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিলেন, তাঁদের কারখানার রাসায়নিক গ্যাসের বিক্রিয়ায় ভ্রূণের ক্ষতি হবে না। আদতে মৃত্যু হয়েছিল বহু প্রসূতি ও গর্ভস্থ শিশুর। আর যে মহিলারা বা তাঁদের গর্ভস্থ সন্তান বাঁচলেন, তাঁদের শরীরে বিষের ছোবল থেকে গেল আজীবন। বিষের আক্রমণে জন্মগত একাধিক ত্রুটি নিয়ে ভূমিষ্ঠ হল শিশু। সেই বিষ, যন্ত্রণা আজও বইছে ভোপাল। তার উত্তর আছে কি কারও কাছে?

(চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

Bhopal Gas Tragedy Bhopal Bhopal disaster
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy