নীরব ছিলেন বলে সমালোচনা হচ্ছিল জোর। মুখ খুলতেই যেন ঢিল পড়ল বিতর্কের চাকে! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত কাল দাদরি-কাণ্ড বা গুলাম আলির বিরুদ্ধাচারণের ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ ও ‘অনভিপ্রেত’ আখ্যা দিলেও স্পষ্ট জানিয়েছেন, এতে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও ভূমিকা নেই। বিরোধীরাই মেরুকরণের রাজনীতি করছে এ সব নিয়ে। হিংসা ও অসহিষ্ণুতার ধারাবাহিক ঘটনা নিয়ে মোদীর এই মন্তব্যে আজ তেড়েফুঁড়ে আক্রমণে নেমেছে বিরোধীরা। অস্বস্তি বাড়িয়েছে বিজেপি-শরিক শিবসেনার মন্তব্যও। ঘরে-বাইরে মিলিত আক্রমণের জবাবে মোদী শিবির আজ পাল্টা তোপ দেগেছে। প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে, সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আসল চেহারাটা নেহাতই ‘ফাঁপা ও বানানো’।
প্রধানমন্ত্রী মোদী কাল সুরটি বেঁধে দেওয়ার পরে অরুণ জেটলি, রবিশঙ্কর প্রসাদের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা আজ একযোগে পাল্টা তোপ দেগেছেন কংগ্রেস-ঘনিষ্ঠ মেকি-ধর্মনিরপেক্ষদের বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির দাবি, ‘‘মোদী-বিরোধী ও বিজেপি-বিরোধীরা নতুন ছক কষেছেন। রাজনীতি শুরু করেছেন অন্য ধরনের অস্ত্র নিয়ে।’’
এই ‘অন্য ধরনের অস্ত্র’টি কী?
তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন জেটলি। তা হল, ‘‘একটা কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করো। তার উপরে দাঁড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কাগুজে বিদ্রোহ ঘটাও। এটাই সহজ রাস্তা।’’ কিন্তু এই সহজ রাস্তায় মোদী সরকারকে কাবু করা যাবে না বলেই জেটলির বিশ্বাস।
মোদীর মতো জেটলিরও দাবি, সাম্প্রতিক যে সব ঘটনা নিয়ে শোরগোল হচ্ছে, সেগুলির জন্য বিজেপি বা কেন্দ্রীয় সরকার দায়ী নয়। আর এক ধাপ এগিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘দেশে আদৌ কোনও অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ নেই। বানানো বিদ্রোহটাই আসলে বিজেপির বিরুদ্ধে নীতিগত অসহিষ্ণুতা।’’
কী বলছে বিরোধীরা?
দাদরির ঘটনা ঘটেছে সপ্তাহ দুই আগে। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে লালুপ্রসাদ আজ বলেন, ‘‘প্রথমে হত্যা করে, পরে প্রতিক্রিয়া দিয়ে কী লাভ?’’ সিপিএমের মহম্মদ সেলিমের প্রশ্ন, ‘‘যে প্রধানমন্ত্রী দেশে-বিদেশে সব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেন, দিল্লি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে দাদরির ঘটনায় মুখ খুলতে তাঁর ১৫ দিন লাগল?’’ একই প্রতিক্রিয়া সমাজবাদী পার্টির আবু আজমিরও, ‘‘দেশ-বিদেশে ঢাক পেটানো মোদীর নাকের তলায় এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, আর তা নিয়ে মুখ খুলতে এত দিন সময় লেগে গেল!’’
প্রধানমন্ত্রী যে ভাবে বিরোধীদের ঘাড়ে দায় ঠেলেছেন, তারও কড়া সমালোচনা করেছে বিরোধী দলগুলি। জেডি(ইউ)-এর কে সি ত্যাগীর মতে, ‘‘লোকসভার আগে মজফ্ফরনগরের মেরুকরণের ফায়দা কে পেল? এখন দাদরির ঘটনা পটনায় পাঠানোর চেষ্টা হচ্ছে, যাতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ফায়দা লোটা যায়।’’ কংগ্রেসের দিগ্বিজয় সিংহ বলেন, ‘‘দাদরির ঘটনায় মোদী দুঃখিত হলে বিজেপির যে নেতারা সেখানে হিংসায়
পরোক্ষে সমর্থন জুগিয়েছেন, তাঁরা ছাড় পাচ্ছেন কেন?’’
নিজস্ব ঘরানায় মোদীকে বিঁধেছে শিবসেনাও। দলের নেতা সঞ্জয় রাউত বলেন, ‘‘গোধরা ও আমদাবাদের জন্য গোটা বিশ্ব নরেন্দ্র মোদীকে মনে রেখেছে। সে জন্য আমরা তাঁকে শ্রদ্ধা করি। তিনি যদি এখন গুলাম আলি ও প্রাক্তন পাক বিদেশমন্ত্রী খুরশিদ কাসুরির ঘটনাকে দুর্ভাগ্যজনক বলেন, সেটিই আমাদের সকলের পক্ষে দুভার্গ্যজনক।’’
বিরোধী-শরিক মিলিত আক্রমণের মুখেও নিজেদের অবস্থান থেকে সরছে না মোদী শিবির। শিবসেনার এই সমালোচনা নিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা সে ভাবে মুখ না খুললেও রাজ্য স্তরে দলের নেতারা ছেড়ে কথা বলছেন না। বিজেপির মুম্বই শাখার সভাপতি আশিস শেলারের প্রশ্ন, প্রাক্তন পাক ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াঁদাদ যখন বালসাহেব ঠাকরের অতিথি হয়ে মাতশ্রীতে গিয়েছিলেন, শিবসেনা যখন সঞ্জয় দত্তের পাশে দাঁড়িয়েছিল, তখন তাদের জাতীয়তাবাদ কোথায় ছিল?
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ এ দিন বলেন, ‘‘দাদরির ঘটনায় আমরা কেউই খুশি নই। এটা দুঃখজনক ঘটনা। কোনও ভাবে আমরা এ সব সমর্থন করি না। প্রধানমন্ত্রীও গোড়া থেকেই খোলাখুলি নিজের মত প্রকাশ করে আসছেন। তবে এটাও ঘটনা, এই ধরনের ঘটনা রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারে পড়ে। বিরোধীরাই এটিকে নিয়ে মেরুকরণের রাজনীতি করছে। এটিকে বেশি করে প্রচারের হাতিয়ার করছে তারাই।’’ বিজেপি নেতারা এ-ও বলছেন, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এটি নিয়ে বেশি হই-চই চান না বলেই এত দিন প্রধানমন্ত্রী নীরব থেকেছেন।
কিন্তু বিরোধীরা দাদরি হত্যাকাণ্ড, এম এম কালবার্গির হত্যা থেকে শুরু করে গুলাম আলিকে মুম্বইয়ে অনুষ্ঠান করতে না-দেওয়া কিংবা সুধীন্দ্র কুলকার্নির মুখে কালি লেপাকে মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মানতে রাজি নন। গুজরাতে হার্দিক পটেলের আন্দোলন যখন মিইয়ে আসার মুখে, তখনই ‘সংরক্ষণ নীতির পর্যালোচনা দরকার’ বলে মন্তব্য করেন আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবত। ওই মন্তব্য নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই মোদী মুম্বইয়ে অম্বেডকর স্মারকের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন, সংরক্ষণ তোলা হবে না। আরও আছে। সাহিত্যিকদের পুরস্কার ফেরত দেওয়া বা ইস্তফা নিয়ে মোদী সরকারের এক মন্ত্রী কাল ওই সাহিত্যিকদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আর আজই সঙ্ঘের শীর্ষ নেতা একই সুরে আক্রমণ করেন এই সাহিত্যিকদের। বিরোধীরা মনে করছেন, এ সবের পিছনে বিজেপি-সঙ্ঘের সুচিন্তিত কৌশল রয়েছে।
বিজেপি এই অভিযোগে আমল না দিয়ে বলে যাচ্ছে, সব বিষয়ে শুধু বিজেপিকে গাল পাড়লে হবে না। যে ঘটনা দুঃখজনক, সেটা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকরাই নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে মেরুকরণের তাস খেলতে চাইছেন। এ নিয়ে যত বিতর্ক হবে, ততই মেকি ধর্মনিরপেক্ষদের মুখোশ খুলে যাবে। অতীতে কংগ্রেস জমানায় এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। ওই সাহিত্যিকরা তখন নীরব থেকেছেন। ‘কংগ্রেস-ঘনিষ্ঠ’ এই ব্যক্তিরা বিভিন্ন পদ থেকে সরে যেতে চাইলে বিজেপির কোনও অসুবিধা নেই। জেটলি আজ এই প্রসঙ্গে এক লেখকের পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন। ওই মহিলা পদ্মশ্রী পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে জানিয়েছেন, ১৯৮৪-র শিখ-গণহত্যার প্রতিবাদেই তাঁর এই পদক্ষেপ। বিস্মিত জেটলির কটাক্ষ, ‘‘গণহত্যার বিরুদ্ধে বিবেক জাগ্রত হতে তিরিশ বছর লেগে গেল ওই লেখিকার!’’
পাশাপাশি মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদও বলেন, ‘‘গুজরাত হিংসার মামলা শুরু করা নিয়ে বরখাস্ত হওয়া আইপিএস অফিসার সঞ্জীব ভট্টের আবেদন সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে দিয়েছে। এটা জলের মতো স্পষ্ট, এই সঞ্জীবই এত দিন কংগ্রেসের হাতে তামাক খেতেন। তিস্তা শেতলওয়াড়ের মতো ব্যক্তিরাও এই গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে মোদী-বিরোধিতা করতেন। আমরা তখনও বলতাম, এটি কংগ্রেসের চক্রান্ত ও অপপ্রচার। আজ সুপ্রিম কোর্টেও তা প্রমাণিত হল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy