(বাঁ দিকে) নীতীশ কুমার ও রাহুল গান্ধী (ডান দিকে)। ছবি: পিটিআই।
কানাঘুষো চলছিল বেশ কিছু দিন ধরেই। তাতে ইন্ধন জোগায় বুধবার বিহারের প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, অনগ্রসর (ওবিসি) নেতা কর্পূরী ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ কর্মসূচিতে নীতীশের মন্তব্য। সব মিলিয়ে বিহার তথা জাতীয় রাজনীতিতে জল্পনা, দেড় বছরের মাথাতেই আবার বিরোধী জোট ছেড়ে বিজেপির সহযোগী হতে চলেছেন নীতীশ কুমার।
১৯৭৮ সালে জনতা পার্টির সরকারের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কর্পূরী প্রথম বিহারে অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) জন্য সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জন্মশতবর্ষে তাকে মরণোত্তর ভারতরত্ন দেওয়ার সিদ্ধান্তের জন্য নরেন্দ্র মোদী সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তথা জেডিইউ প্রধান নীতীশ। পাশাপাশি তাঁর ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ মন্তব্য— ‘‘জেডিইউ নেতৃত্ব কর্পূরী ঠাকুরের দর্শন অনুসরণ করে চলেছেন। পরিবারের কোনও সদস্যকে আমরা রাজনৈতিক ক্ষমতার বৃত্তে নিয়ে আসি না।’’ এ প্রসঙ্গে প্রয়াত কর্পূরীর পুত্র তথা জেডিইউর রাজ্যসভা সাংসদ রামনাথের উদাহরণ দেন নীতীশ। বলেন, “কর্পূরীরজির মৃত্যুর পরে আমরা রামনাথকে নেতৃত্বে নিয়ে এসেছিলাম।”
কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনের নাম না করলেও নীতীশের ওই মন্তব্যের নিশানা আরজেডি প্রধান লালুপ্রসাদ এবং তাঁর পরিবার বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের ধারণা। জয়প্রকাশ নারায়ণের মতোই সমাজবাদী (সোশ্যালিস্ট) নেতা কর্পূরীও ছিলেন লালু-নীতীশদের অন্যতম রাজনৈতিক পথপ্রদর্শক। যে ভাবে লালু তাঁর স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠত করার বন্দোবস্ত করেছেন তা নিয়েই নীতীশ কটাক্ষ করেন বলে আরজেডি শিবিরের একাংশের দাবি। বস্তুত, বৃহস্পতিবার সকালে লালু-কন্যা রোহিণী এক্স হ্যান্ডলে একটি পোস্টে নীতীশকে আক্রমণও করেন। যদিও পরে পোস্টটি মুছে দেওয়া হয়।
যদিও রাজনৈতিক তৎপরতা তাতে থামেনি। বৃহস্পতিবার প্রাক্তন জেডিইউ সভাপতি লালন সিংহ, বিহার বিধানসভার স্পিকার বিজয় নারায়ণ চৌধুরীর মতো ঘনিষ্ঠ নেতাদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেন নীতীশ। অন্য দিকে, বিহার বিজেপির সভাপতি সম্রাট চৌধুরী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা সে রাজ্যের বিজেপি নেতা অশ্বিনী চৌবে রওনা দিয়েছেন দিল্লিতে। জল্পনা চলছে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত হবে এনডিএ-তে নীতীশের প্রত্যাবর্তনের ‘রোড ম্যাপ’।
২০২০ সালে বিহারের বিধানসভা ভোটে বিজেপির সঙ্গে লড়ে জিতলেও ২০২২ সালের অগস্টে এনডিএ ছেড়ে বিহারে আরজেডি-কংগ্রেস-বামেদের সমর্থন নিয়ে ‘মহাগঠবন্ধন’ সরকার গড়েছিলেন নীতীশ। কেন আবার তিনি বিজেপির সঙ্গী হতে চাইছেন? জেডিইউ-র একটি সূত্র জানাচ্ছে, ‘ইন্ডিয়া’ সম্পর্কে মোহভঙ্গ হয়েছে তাঁর। তাই আবার ফিরতে চান এনডিএতে। এ প্রসঙ্গে উঠে আসছে তিনটি ‘কারণ’।
প্রথমত, দেশের সব রাজ্যে ঘুরে ঘুরে জোটের পটভূমিকা তৈরি করেছিলেন নীতীশ। জোটের প্রথম বৈঠকও হয়েছিল তাঁরই ব্যবস্থাপনায় পটনায়। কিন্তু পরে বেঙ্গালুরু, মুম্বই ও দিল্লিতে জোটের বৈঠকে তাঁকে সে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। জোটের নাম ‘ইন্ডিয়া’ করাতেও তাঁর আপত্তিকে অগ্রাহ্য করা হয়। একই সঙ্গে নীতীশ নিজেই বিরোধী জোটের আহ্বায়ক হতে আগ্রহী হলেও কয়েকটি শরিক দলের আপত্তিতে তা কার্যকর হয়নি।
দ্বিতীয়ত, ৭৯ বিধায়কদের দল আরজেডি বেশ কিছু দিন ধরেই মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়তে চাপ দিচ্ছে তাঁকে। লালু চান তার পুত্র তথা উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বীর হাতে পটনার কুর্সি তুলে দিতে। নীতীশের দলের বিধায়ক সংখ্যা মাত্র ৪৫। ফলে মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকতে হলে বিজেপির ৭৮ বিধায়কের সমর্থন তার প্রয়োজন। নীতীশকে সমর্থনের বিষয়ে বিহারের বিজেপি নেতৃত্বের একাংশের তীব্র আপত্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত লোকসভা ভোট ‘পাখির চোখ’ করে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা নীতীশকে পটনার কুর্সিতে বহাল রাখতে পারেন বলে সূত্রের খবর।
তৃতীয়ত, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপির সঙ্গে জোটে ১৭টি আসনে লড়াই করে ১৬টিতে জয় পেয়েছিলেন নীতীশ। বিজেপি ১৭টিতে লড়ে সবগুলি এবং প্রয়াত রামবিলাস পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি (এলজেপি) ৬টিতে পড়ে সবগুলি জিতেছিল। ৪০টি আসনের মধ্যে বিরোধী জোটের এক মাত্র কংগ্রেস একটি আসনে জিতেছিল। লালুর দলের ঝুলি ছিল শূন্য! স্বাভাবিক ভাবেই নিজেদের দখলে থাকা ১৬টি আসন ছাড়তে চান না নীতীশ। কিন্তু সেই ১৬টির মধ্যে এমন ৪-৫টি আসন রয়েছে, যা দাবি করছে আরজেডি এবং বামেরা!
প্রায় দু’দশক আগে বিহারে যাদব পরিবারতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে বিজেপির সমর্থনেই প্রথম বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন নীতীশ। কিন্তু ২০১৩ সালে বিজেপি মোদীকে ‘প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী’ ঘোষণা করায় এনডিএ ছাড়েন তিনি। নীতীশের একদা ঘনিষ্ঠেরা বলেন, সে সময়ে তাঁর লক্ষ্য ছিল, ভোটের পরে অ-কংগ্রেস দলগুলি ভাল ফল করলে সেই জোটের নেতা হিসেবে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবি জানানো। কিন্তু ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোদীর বিপুল ভোটে জয় নীতীশের পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেয়। উল্টে বিহারে ৪০টি লোকসভা আসনের মধ্যে মাত্র দু’টি আসন পায় নীতীশের দল।
২০১৫-য় আরজেডি-কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে বিহারের বিধানসভা ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী হলেও ‘বাস্তব পরিস্থিতি’ বুঝতে পেরে ২০১৭-র জুলাই মাসে এনডিএ-তে ফিরে গিয়েছিলেন নীতীশ। ২০১৯-এর লোকসভা এবং ২০২০-র বিহার বিধানসভা ভোটে বিজেপির জোটসঙ্গী কুর্মি নেতা ২০২২-এর অগস্টে বিজেপি বিরোধী ‘মহাগঠবন্ধন’ গড়ার পরে আপাতত ‘ইন্ডিয়া’য়। আবার লোকসভা নির্বাচন আসন্ন। আবার কী নতুন ভূমিকায় দেখা যাবে তাঁকে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy