Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
নগরোন্নয়নে বাবুল

পুরভোটের আগে ‘হাফ-মন্ত্রী’ই কাঁটা তৃণমূলের

রাজ্যের পূর্ণ মন্ত্রী বলছেন, “উনি হাফ-মন্ত্রী হয়েছেন!” যা শুনে সদ্য কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী হওয়া বাবুল সুপ্রিয় বলছেন, “আমি রাজনীতিতে আসার আগে থেকে তিনি আমাকে চেনেন। তাঁর ক্লাবের হয়ে রক্তদানও করেছি। আমি বিশ্বাস করি, এ কথা তিনি মন থেকে নয়, রাজনৈতিক কারণে বলেছেন!” বস্তুত, কেন্দ্রে বাবুল সুপ্রিয়ের মন্ত্রিত্ব পাওয়াকে কটাক্ষ করে রবিবার আসানসোলেই রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় যা বলেছেন, তা আসলে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বেরই অভিমত।

শপথের পরে রাস্তার ধারে বসে এক কাপ চা।—নিজস্ব চিত্র।

শপথের পরে রাস্তার ধারে বসে এক কাপ চা।—নিজস্ব চিত্র।

সুশান্ত বণিক
আসানসোল শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:১৯
Share: Save:

রাজ্যের পূর্ণ মন্ত্রী বলছেন, “উনি হাফ-মন্ত্রী হয়েছেন!”

যা শুনে সদ্য কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী হওয়া বাবুল সুপ্রিয় বলছেন, “আমি রাজনীতিতে আসার আগে থেকে তিনি আমাকে চেনেন। তাঁর ক্লাবের হয়ে রক্তদানও করেছি। আমি বিশ্বাস করি, এ কথা তিনি মন থেকে নয়, রাজনৈতিক কারণে বলেছেন!”

বস্তুত, কেন্দ্রে বাবুল সুপ্রিয়ের মন্ত্রিত্ব পাওয়াকে কটাক্ষ করে রবিবার আসানসোলেই রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় যা বলেছেন, তা আসলে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বেরই অভিমত। সুব্রতবাবু বলেছেন, “উন্নয়নের ক্ষেত্রে হাফ-মন্ত্রীর কোনও ভূমিকা নেই। এতে আসানসোলবাসীকে অসম্মানই করা হয়েছে!” তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বেরও বক্তব্য, এর আগেও এনডিএ জমানায় এ রাজ্য থেকে বিজেপি-র দু’জন মন্ত্রী হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারে। তাঁরা রাজ্যের জন্য কী করতে পেরেছেন, সেই অভিজ্ঞতা রাজ্যবাসীর আছে।

কিন্তু শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে এখন একমত নন শাসক দলেরই আসানসোলের অনেক নেতা! লোকসভা ভোটের প্রচারের সময় আসানসোলে তৃণমূলের যে নেতা-কর্মীরা বাবুলকে হেনস্থা করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন, পুরভোটের আগে তাঁদেরই অনেকের গলায় এখন অন্য সুর! তাঁরা বলছেন, “হাফ-মন্ত্রী হলেও মন্ত্রী তো! কাজ করতে পারলে কিন্তু এই হাফ-মন্ত্রীই মানুষের সমর্থন পাবেন।” বিজেপি-র এক রাজ্য নেতাও বলছেন, “হাফ না ফুল-মন্ত্রী, পুরভোটের পরে ওঁরা টের পাবেন!”

বিজেপি নেতার এই কথা বলার পিছনে যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন অনেক তৃণমূল নেতাই। বিশেষ করে আসানসোলে যাঁদের এই মুহূর্তে মাটি কামড়ে লড়তে হচ্ছে। এই সব নেতা আড়ালে বলছেন, সামনেই একসঙ্গে একাধিক পুরসভায় ভোট। তার আগে বাবুলের মতো উদ্যোমী সাংসদকে নগরোন্নয়নে এনে ‘মাস্টার স্ট্রোক’ দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। অনেকে কাজের ক্ষেত্রে ইউপিএ জমানায় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সির থেকে এগিয়ে রাখছেন বাবুলকে। তাঁদের বক্তব্য, শহরাঞ্চলে তৃণমূল জমি হারাচ্ছে। সেখানে বাবুল যদি উন্নয়নের গতি বাড়াতে পারেন, তা হলে আসন্ন পুরভোটগুলিতে বিজেপি অনেকটাই সুবিধা পেয়ে যাবে।

আসানসোলের নেতা-কর্মীরা তো স্পষ্টতই জানাচ্ছেন, তাঁদের এখনই লড়তে হচ্ছে ৪৫-৫ ফলে পিছিয়ে থেকে। লোকসভা ভোটের নিরিখে ৫০ ওয়ার্ডের পুরসভায় এটাই ছিল ‘ফল’। ৩৫ ওয়ার্ডের কুলটিতে পিছিয়ে ৩৩-২ ফলে। তাই কখনও মদ্যপ অবস্থায় প্রচার, কখনও বা অস্ত্র আইনে মামলা লোকসভা ভোটের আগে এমন নানা উপায়ে বাবুলকে কোণঠাসা করার আঙুল উঠেছিল যে তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে, তাঁরাই এখন অন্য রকম ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন।

দেখতে গেলে, বাবুলকে নিয়ে তৃণমূলের আসলে এখন উভয় সঙ্কট! শীর্ষ নেতৃত্ব ভাবছেন, বাবুলকে বেশি গুরুত্ব দিতে গেলে যদি হিতে আরও বিপরীত হয়! আবার স্থানীয় নেতারা ভাবছেন, কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়ে সাংসদ বাবুল আরও কাজ করে দেখালে পুরভোটে বিজেপি-ই তার ফায়দা নেবে। তাই তাঁদের লড়তে হবে সতর্ক হয়ে। তৃণমূলের মধ্যেই যে দু’রকম মত উঠে আসছে, তা থেকে দলের জন্য অশনি সঙ্কেতই স্পষ্ট!

ঘটনা হল, ইউপিএ-২ জমানায় এ রাজ্যে তৃণমূল থেকেও ৭ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। সুব্রতবাবুদের যুক্তি মানলে তাঁদেরও তা হলে ‘হাফমন্ত্রী’ই ধরতে হয়! তৃণমূল নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, কংগ্রেস সরকার তাঁদের প্রতিমন্ত্রীদের বিশেষ কাজ দিত না। তাই তাঁরা যোগ্যতা প্রমাণের বিশেষ সুযোগ পাননি। পাশাপাশিই তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা বলছেন, “কেউ মন্ত্রী হলে তিনি আরও বেশি করে নজরে চলে আসেন। তাঁর ব্যর্থতাও তখন বেশি করে চোখে পড়ে। বিজেপি-র এক জন মন্ত্রী হওয়ায় বরং শাপে বর হল!”

আসানসোলের নেতারা কিন্তু এমনটা বলতে পারছেন না! বাবুলের বিরুদ্ধে মদ্যপ অবস্থায় প্রচারের আঙুল তোলার পিছনে যাঁর হাত ছিল বলে বিজেপি নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, আসানসোল পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান সেই জিতেন্দ্র তিওয়ারি এ দিন বলেছেন, “রাজ্য বা শিল্পাঞ্চলের জন্য গঠনমূলক কাজ করলে আমরা ওঁকে সমর্থন করব।” যাঁর অভিযোগে বাবুলের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হয়েছিল, রানিগঞ্জের সেই তৃণমূল নেতা সেনাপতি মণ্ডলের বক্তব্য, “এই শিল্পাঞ্চলের অনেক সমস্যা আছে। এলাকায় যদি এক জন হাফ-মন্ত্রীও থাকেন, তাঁর তহবিল থেকে উন্নয়নের কাজ হবে। উনি উন্নয়ন করতে পারলে মানুষের সমর্থনও পাবেন।” তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি (শিল্পাঞ্চল) ভি শিবদাসন আবার বলেন, “রাজ্যে উন্নয়ন তৃণমূল করছে। তবে এখন আমাদের আরও বেশি করে কাজ করতে হবে।”

সিপিএম অবশ্য বাবুলের মন্ত্রিত্ব পাওয়া নিয়ে মন্তব্যে যেতে নারাজ। বাবুলের কাছে হেরে সাংসদ পদ খোয়ানো আসানসোলের সিপিএম নেতা বংশগোপাল চৌধুরী বলছেন, “এ নিয়ে এখনই কিছু বলার নেই।”

ভোটের আগে বাবুলের সমর্থনে আসানসোলে সভা করতে এসে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, “সংসদে আমার বাবুলকে চাই!” প্রায় ৭০ হাজার ভোটে জিতে বাবুল সংসদে গিয়েছেন। এ বার সেই বাবুলকে মন্ত্রী করে আসানসোল তথা এ রাজ্যে আসন্ন পুরভোটকে তাঁরা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন, মোদী তা বুঝিয়ে দিলেন বলে মনে করছেন বিজেপি নেতারা। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “কেন্দ্র রাজ্যের জন্য কাজ করবে, এই প্রতিশ্রুতি অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদী বারবার দিয়েছেন। কেন্দ্র মানুষের কাজ নিয়ে ভেদা করে না। বাবুল মন্ত্রী হয়ে ওর কাজ করবে।” আসানসোল জেলা সভাপতি নির্মল কর্মকারের দাবি, “লোকসভা ভোটের পরে এই এলাকায় নানা দল থেকে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আমাদের দলে এসেছেন। আরও অনেকে আসতে চান। আসানসোল-দুর্গাপুরে বিজেপি-ই শেষ কথা বলবে, এমন দিন বেশি দূরে নেই!”

আসানসোল থেকে বাবুলই প্রথম কেন্দ্রে মন্ত্রী হলেন। তাই এ দিন তিনি শপথ নেওয়ার পরে এই খনি-শিল্পাঞ্চলের এলাকায় বাজি পোড়ানো, আবির খেলায় মাতেন বিজেপি কর্মীরা। আসানসোলের গির্জা মোড় থেকে বড় মিছিল বেরোয়। বিজেপি কর্মীরা ছাড়াও সাধারণ মানুষ তাতে সামিল হন। কলকাতাতেও মিছিল করে বিজেপি-র যুব মোর্চা। বাবুল এক সময়ে যেখানকার বাসিন্দা ছিলেন, সেই উত্তরপাড়া, ব্যান্ডেলেও এ দিন খুশির মেজাজ। ফরওয়ার্ড ব্লকের হুগলি জেলা চেয়ারম্যান নৃপেন চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, “হুগলির মানুষ হিসেবে আমরা গর্বিত। উনি নিশ্চয় রাজ্যের যাতে ভাল হয়, সে দিকে নজর দেবেন।” বাবুল মন্ত্রী হওয়ায় খুশি বণিক মহলও। আসানসোল বণিকসভার সভাপতি সুব্রত দত্ত এই ঘটনাকে গর্বের বিষয় হিসাবেই দেখছেন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE