সেতুভঙ্গে আহত তরুণকে ঘিরে রেখেছেন পরিবারের লোক। মোরবীর একটি হাসপাতালে। মঙ্গলবার। রয়টার্স
মোরবীতে মৃত্যুমিছিলের পরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই বিপর্যয়ে ভোটমুখী গুজরাতে তাঁকে, তাঁর দলকে যথেষ্ট বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, মোরবী সেতু মেরামতে যে সংস্থার দায়িত্ব ছিল, বিপর্যয়ের পরে এফআইআরে সেই সংস্থার শীর্ষ কর্তাদের নাম কোথায়! শুধু তাই নয়, সেতুর মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণে ওই সংস্থাটিকে খোলাখুলি ছাড় দিয়েছিল প্রশাসন। তা হলে এই দুর্ঘটনার দায় স্থানীয় প্রশাসন এবং গুজরাত সরকার এড়াতে পারে কি না সেই প্রশ্নও উঠছে।
তদন্তের গতিপ্রকৃতি দেখে বিরোধীদের আশঙ্কা, বেসরকারি সংস্থাটির কর্তা-ব্যক্তিদের যেমন আড়ালের চেষ্টা হচ্ছে, তেমনই বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে সরকারি আধিকারিক, নেতা-মন্ত্রীদেরও। আম আদমি পার্টি (আপ)-র প্রধান তথা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়ালের অভিযোগ, গুজরাত সরকারের দুর্নীতির পরিণামেই সেতু বিপর্যয়। আর কংগ্রেসের সন্দেহ, এ বার সেতু দুর্ঘটনা থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা শুরু করবে গুজরাত সরকার এবং বিজেপি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ মোরবীর দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। আধিকারিকদের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রী দুর্ঘটনার সবিস্তার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘প্রয়োজনে গভীরে গিয়ে তদন্ত করতে হবে। চিহ্নিত করতে হবে দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত দিকগুলি। তার থেকে শিক্ষা নিতে হবে।’’
কিন্তু তদন্তে আসল দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেতুভঙ্গের অভিযোগে গুজরাতের বিজেপি সরকারের পুলিশ যে এফআইআর করেছে, তাতে ‘ওরেভা’ সংস্থার নামই নেই। নাম নেই সেতুর তদারকির দায়িত্বে থাকা মোরবী পুরসভার সংশ্লিষ্ট আধিকারিকেরও। স্থানীয় লোকজনের বক্তব্য, ‘ওরেভা’র দু’জন ম্যানেজার, দু’জন শ্রমিক, তিন জন নিরাপত্তাকর্মী এবং দু’জন টিকিট বিক্রেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এঁদের ‘বলির পাঁঠা’ করে মূল অভিযুক্তদের আড়ালের চেষ্টা হচ্ছে।
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জন্য যে ব্যক্তির দিকে সবার আগে আঙুল উঠছে, তিনি হলেন ‘ওরেভা’র কর্ণধার জয়সুখভাই পটেল। সেতু খোলার আগে ‘ফিটনেস সার্টিফিকেট’ তো ছিলই না, সেতুটি পরীক্ষা করেও দেখা হয়নি। মেরামতের পরে যে দিন সেতুটি উদ্বোধন হয়, সেই অনুষ্ঠানে কোনও সরকারি আধিকারিক উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু জয়সুখভাই সপরিবারে হাজির ছিলেন। প্রাথমিক তদন্তে সামনে এসেছে, গুজরাতি নববর্ষে বহু লোক ওই সেতু দেখতে আসবেন, তাই আর্থিক লাভের আশায় তড়িঘড়ি সেতু খুলে দেওয়া হয়। দুর্ঘটনার পর থেকেই বন্ধ ‘ওরেভা’ সংস্থার দফতর।
দায়িত্ব এড়াতে পারে না মোরবী পুরসভাও। পুরসভার সিএমও সন্দীপসিন জালা গত কালই বলেছিলেন, সেতুর ‘ফিটনেস সার্টিফিকেট’ নেওয়া হয়নি। কিন্তু সেতু পাঁচ দিন খোলা ছিল। তা সত্ত্বেও পুর কর্তৃপক্ষ কেন তাঁদের ইঞ্জিনিয়ারদের পাঠিয়ে সেতুর গুণমান এবং ভারবহন ক্ষমতা পরীক্ষা করলেন না সেই প্রশ্নও উঠছে। কার নির্দেশে হাত গুটিয়ে বসেছিল মোরবী পুরসভা?
সেতু মেরামতের চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের সময়ে হাজির ছিলেন মোরবীর জেলাশাসক জি টি পাণ্ড্য। সূত্রের খবর, ‘ওরেভা’ এবং মোরবী পুরসভার মধ্যে গত ৬ মার্চ যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছে, কোম্পানি টিকিটের হার বাড়াতে পারবে, সেতুটি বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করতে পারবে এবং সরকারি সংস্থার কোনও হস্তক্ষেপ থাকবে না। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটলে দায় কার সে বিষয়ে তিন পৃষ্ঠার চুক্তিতে কোথাও কোনও উল্লেখ নেই। অর্থাৎ, এটা স্পষ্ট যে সেতুর দায়িত্ব থেকে একেবারে হাত গুটিয়ে নিয়েছিল প্রশাসন। খোলাখুলি ছাড় দেওয়া হয়েছিল ‘ওরেভা’কে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, এমন চুক্তি যে সরকারি আধিকারিকেরা করলেন, তাঁরাও কি দুর্ঘটনার জন্য দায়ী নন!
বিরোধী শিবিরের বক্তব্য, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মোদী নিজেকে ‘ধর্মযোদ্ধা’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন। অথচ, তাঁর রাজ্যে, তাঁর দল পরিচালিত সরকারের আমলে সেতু বিপর্যয়ের তদন্ত এত ঢিলেঢালা, ফাঁকফোকরযুক্ত কেন! এটাই কি মোদীর ‘গুজরাত মডেল’।
তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে কংগ্রেসের মুখপাত্র পবন খেরা বলেছেন, ‘‘আসল অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে। তাতে যেমন বেসরকারি সংস্থার লোকজন রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন সরকারি আধিকারিক, মন্ত্রী, বিজেপি নেতা। কে সেতু খোলার অনুমতি দিল তা-ও আড়াল করা হচ্ছে। এর পরে মোরবীর ঘটনা থেকে নজর সরানোর চেষ্টা হবে।’’ গুজরাতের বিজেপি সরকারকে বিঁধে কেজরীওয়াল বলেন, ‘‘যে সংস্থা ঘড়ি তৈরি করে, তাকে সেতু মেরামতের দরপত্র দেওয়া হল কেন? তার মানে ওই সংস্থার সঙ্গে বিজেপির যোগাযোগ রয়েছে।’’ তাঁর অভিযোগ, ওই সংস্থার থেকে মোটা টাকা অনুদান পেয়েছিল বিজেপি। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র পটেলকে নিশানা করে কেজরীর দাবি, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী অবিলম্বে পদত্যাগ করুন। ওই পদে থাকার কোনও অধিকার তাঁর নেই। অবিলম্বে নির্বাচন হোক।’’ কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরমের প্রশ্ন, ‘‘ওরেভা এবং পুর কর্তৃপক্ষের নাম এফআইআরে নেই কেন? সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী কেন পদত্যাগ করলেন না— এই প্রশ্নগুলির উত্তর গুজরাত সরকার ও বিজেপি ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পরেও দিচ্ছে না। প্রশ্ন করলেই বলা হবে মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। আর যদি উত্তর না দেওয়া হয়, তা হলে কী বলা হবে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy