Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মাওবাদী মোকাবিলায় যান না বাহিনীর কর্তারা

ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া তো দূর, উল্টে একই ভুলের ফাঁদে পা দিয়েই ছত্তীসগঢ় কার্যত হয়ে উঠেছে আধা সামরিকবাহিনীর বধ্যভূমি। কেন্দ্রকে তাই এখন নতুন রণকৌশল নেওয়ার কথা ভাবতে হচ্ছে। এই রাজ্যে পরপর তিন দিনে চারটি হামলায় মারা গিয়েছেন বারো জনের বেশি নিরাপত্তা কর্মী। অথচ প্রতিপক্ষে মাওবাদী হামলাকারীদের মাত্র এক জন মারা গিয়েছেন। তাতেই এটা বেশ স্পষ্ট যে, বস্তার-সুখমা বা দন্তেওয়াড়ার মতো এলাকায় মাওবাদী মোকাবিলার বর্তমান রণকৌশল কাজে আসছে না।

অনমিত্র সেনগুপ্ত
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৫ ০৪:৪৩
Share: Save:

ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া তো দূর, উল্টে একই ভুলের ফাঁদে পা দিয়েই ছত্তীসগঢ় কার্যত হয়ে উঠেছে আধা সামরিকবাহিনীর বধ্যভূমি। কেন্দ্রকে তাই এখন নতুন রণকৌশল নেওয়ার কথা ভাবতে হচ্ছে। এই রাজ্যে পরপর তিন দিনে চারটি হামলায় মারা গিয়েছেন বারো জনের বেশি নিরাপত্তা কর্মী। অথচ প্রতিপক্ষে মাওবাদী হামলাকারীদের মাত্র এক জন মারা গিয়েছেন। তাতেই এটা বেশ স্পষ্ট যে, বস্তার-সুখমা বা দন্তেওয়াড়ার মতো এলাকায় মাওবাদী মোকাবিলার বর্তমান রণকৌশল কাজে আসছে না। দরকার নতুন কোনও কৌশল। এমনকী, আলাদা করে মাওবাদী দমনের জন্যই বিশেষ একটি বাহিনীও। এই সব নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছে সরকারে।

গত শুক্র ও শনিবারের হামলার ঘটনা সামনে আসার পরেই সমস্যার উৎস খুঁজতে নির্দেশ দেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। জানতে বলেন, মাওবাদীদের হাতে কেন মার খেতে হচ্ছে নিরাপত্তাবাহিনীকে। এরই সূত্রে সাম্প্রতিক বিভন্ন হামলার চরিত্র ও গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে কয়েকটি বিষয় প্রকট হয়ে উঠেছে। সেগুলি এই রকম:

• বারবার বলা হলেও রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বাহিনীগুলির মধ্যে তথ্য সমন্বয়ের অভাব রয়েই গিয়েছে।

• যে নিরাপত্তারক্ষীদের ওই সব এলাকায় পাঠানো হচ্ছে, তাঁদের অনেেকরই জঙ্গল এলাকায় লড়ার মতো উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নেই।

• সুনির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা না থাকা। নিরাপত্তার নিয়মগুলি না মানা। এবং অবশ্যই

• মাওবাদী দমনে যোগ্য নেতার অনুপস্থিতি।

বিশেষ চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে ওই সর্বশেষ কারণটি। মাওবাদী দমনে ছত্তীসগঢ়ে বর্তমানে রাজ্য পুলিশের বিশেষ বাহিনী (এসটিএফ) ছাড়াও মোতায়েন রয়েছে সিআরপিএফ, এসএসবি, বা বিএসএফের একাধিক কোম্পানি। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বলছে, অভিযানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন জুনিয়র অফিসার। গত শনিবার এসটিএফের বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন একজন সাব-ইনস্পেক্টর। অভিযোগ, পদস্থ আধিকারিকরা উপদ্রুত এলাকায় যাওয়ার বদলে রায়পুরে থাকতেই পছন্দ করছেন। কার্যত বাধ্য হয়েই নেতৃত্ব দিচ্ছেন জুনিয়র অফিসাররা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্য, যে কোনও হামলার সময় পরিস্থিতি বুঝে কয়েক মিনিটের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু আপৎকালীন পরিস্থিতিতে সদর দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে পদস্থ কর্তাদের পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ কার্যত থাকে না। আর সেই পরিস্থিতিতে এক জন জুনিয়র ও সিনিয়র অফিসারের মধ্যে অভিজ্ঞতার ফারাকটাই বড় হয়ে ওঠে।

মাওবাদী মোকাবিলার কৃতিত্ব কে নেবে, বরাবরের এই দ্বন্দ্ব থেকে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বাহিনীগুলি পরস্পরের মধ্যে তথ্য বিনিময় করতে চায় না। এটাও একটা বড় সমস্যা। কোনও হামলা মোকাবিলাই হোক বা অভিযান, বাহিনীগুলির মধ্যে (রিয়েল টাইম বেসিসে) তথ্যের তাৎক্ষণিক আদানপ্রদান হওয়াটা জরুরি। সেটাই হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। অথচ, মাওবাদীদের অনেকেই স্থানীয় বাসিন্দা। গ্রামবাসীরাও তাদের পাশে। ফলে নিরাপত্তাবাহিনীগুলি কার্যত অন্ধকারে থেকে যায়। তাই রাজ্যের ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় কী ভাবে বাড়ানো যায়, তার জন্য নতুন কোনও ‘প্রোটোকল’ তৈরির কথাও ভাবছে মন্ত্রক।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এ-ও বক্তব্য, অভিযানে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাঁধাধরা কিছু নিয়ম মানতে হয়। মাওবাদী মোকাবিলার অভিযানে যাওয়ার সময় বাহিনীগুলি সেই নিয়ম মানছে না অধিকাংশ সময়। গত ১ ডিসেম্বর সিআরপিএফের উপরে হামলার পর থেকে প্রতিটি টহলদার দলের পিছনে একটি করে ‘ব্যাক আপ টিম’ থাকা আবশ্যিক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু গত শনিবার এসটিএফ-এর যে বাহিনীটি হামলার শিকার হয়েছে, তাদের পিছনে তেমন কোনও সাহায্যকারী দল ছিল না। একই ঘটনা ঘটে পরের দিন বিএসএফ বাহিনীর সঙ্গে। তা ছাড়া, অন্তত দু’শো জনের নিরাপত্তবাহিনীর একটি দল নিয়ে মাওবাদী অপারেশনে যাওয়া দস্তুর। কিন্তু শনিবার এসটিএফের দলটিতে ছিলেন পঞ্চাশ জনেরও কম। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, হামলাকারীরা সংখ্যায় ছিল দু’শোর কাছাকাছি। সমানে-সমানে সংখ্যা থাকলে ওই বাহিনীর এত ক্ষয়ক্ষতি হত না বলেই মনে করছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। নিরাপত্তাবাহিনীর বহর দেখে সংঘর্ষ এড়িয়েও যেতে পারত মাওবাদীরা।

সব চেয়ে যেটা চিন্তার বিষয়, তা হল, এই ভুলগুলির কোনওটিই নতুন নয়। হামলার ঘটনা-পরম্পরা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, অতীতের ভুল থেকে কোনও শিক্ষা নেয়নি নিরাপত্তাবাহিনীগুলি। ২০১০ সালে সুখমার হামলায় ৭৬ জন জওয়ান মারা যান। গত শনিবারের হামলাটিও হয়েছে, ওই একই এলাকায়, একই ভাবে ফাঁদ পেতে। অভাব উপযুক্ত প্রশিক্ষণেরও। সিআরপিএফ বা বিএসফের মতো বাহিনীগুলি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হলেও পাহাড়ে-জঙ্গলের মতো কঠিন ভূ-প্রকৃতিতে লড়াই চালানার ক্ষেত্রে তারা ততটা দক্ষ নন।

কথাটা দীর্ঘদিন ধরেই বলে যাচ্ছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের বক্তব্য মাওবাদী-ঘাঁটিতে তাদের সঙ্গে লড়তে হলে তাদের মতো করেই গেরিলা লড়াই শিখতে হবে। কিন্তু সিআরফিএফের মতো বাহিনীকে মূলত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল উগ্রপন্থীদের সঙ্গে লড়ার জন্য। গেরিলা পদ্ধতি তাদের কাছে অজানা। তা ছাড়া, স্থানীয় ভূ-প্রকৃতি জানার জন্য একটি বাহিনীর অন্তত কিছু সময় ধরে সেই এলাকায় থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এখন বিভিন্ন রাজ্যে ভোট ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সিআরপিএফের ব্যবহার অনেক বেড়ে গিয়েছে। ফলে উপদ্রুত এলাকাগুলি থেকে প্রায়ই তাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ফলে উপদ্রুত এলাকা বা সেখানকার বাসিন্দাদের সম্পর্কে ভাল ভাবে জানার আগেই সরে যেতে হচ্ছে তাদের। এরই সুযোগ নিচ্ছে মাওবাদীরা। এই পরিস্থিতিতে মাওবাদী দমনে একটি বিশেষ বাহিনী গঠন করা নিয়েও ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছে সরকারে।

মালকানগিরিতে অপহৃত ন’জন

গত তিন দিনে ছত্তীসগঢ়ে হামলার পর এ বার অপহরণেরও অভিযোগ উঠল মাওবাদীদের বিরুদ্ধে। ছত্তীসগঢ় সীমানা লাগোয়া ওড়িশার মালকানগিরির মাথিলি ব্লকের দু’টি গ্রাম থেকে সোমবার ৯ জনকে অপহরণ করা হয়েছে। গ্রামের ৫ জন ও লাগোয়া বরহা গ্রামের ২ জনকে অপহরণ করা হয়। ডিজিপি সঞ্জীব মারিক জানান, এঁদের প্রত্যেককেই বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মাওবাদীরা এখনও এর দায় স্বীকার করেনি। ঘটনার দিন মাঝরাতে সশস্ত্র এক দল মাওবাদী গ্রামে ঢুকে কীর্তনপল্লি গ্রামের ওয়ার্ড সদস্যদের খোঁজ করে। প্রথমে আলোচনার জন্যই ডেকে আনা হয় তাঁদের। পরে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে অপহরণ করা হয়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE