ধসে পড়ছে বদ্রীনাথ ও হেমকুণ্ড সাহিব, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-সহ একাধিক স্থানে যাওয়ার ‘গেটওয়ে’ জোশীমঠ। — ফাইল ছবি।
নিজের অস্তিত্ব দিয়ে উন্নয়নের মাসুল গুনছে জোশীমঠ? বাড়ি, রাস্তা, পাহাড়, বাগান— সর্বত্র শুধু ফাটল আর ফাটল। জনপদকে বসবাসের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যত্র পুনর্বাসনের যন্ত্রণার প্রমাদ গুনছেন সাধারণ জোশীমঠবাসী। আস্তে আস্তে আলগা হচ্ছে মাটি। সরে সরে যাচ্ছে পাথর। ধসে পড়ছে বদ্রীনাথ ও হেমকুণ্ড সাহিব, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-সহ একাধিক স্থানে যাওয়ার ‘গেটওয়ে’ জোশীমঠ। হিন্দি সংবাদপত্র ‘দৈনিক ভাস্কর’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, আর কেউ বাঁচাতে পারবে না জোশীমঠকে। তাঁদের একটি অংশের মতে, আজকের জোশীমঠের এমন অকাল বিসর্জনের আসল কারণ লুকিয়ে এক সুড়ঙ্গের গভীরে।
এ যেন অন্তহীন হোঁচট খাওয়ার গল্প। উত্তরাখণ্ডের গাড়োয়াল পাহাড়ের কোলে ছোট্ট জনপদ জোশীমঠ। ১৯৩৯-এ প্রথম বার এই জনপদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন ওঠে। তার পর কেটে গিয়েছে ৮৪ বছর। উন্নয়নের পালতোলা নৌকায় সওয়ার হয়ে সে দিনের ছোট্ট জনপদ আজ রীতিমতো বড় শহর। কিন্তু বিপদের ঘণ্টা বেজেছিল ২০০৯-এ।
ক্যালেন্ডারে ২৪ ডিসেম্বর, ২০০৯। জোশীমঠের কাছেই এক পাহাড়ের পেটে আচমকা থমকে গেল একটি সুড়ঙ্গ খোঁড়ার যন্ত্র। পরিভাষায় নাম ‘টানেল বোরিং মেশিন’ (টিবিএম)। কারণ, সামনে হাজার হাজার গ্যালন জল! মাসের পর মাস কেটে যায়, জলের স্রোত কমে না। তাবড় ইঞ্জিনিয়াররা দেখে যান, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। জলধারার বিরাম নেই। পরে কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, মানুষের তৈরি যন্ত্র প্রকৃতির তৈরি একটি বিরাট জলভান্ডারে ছিদ্র করে দিয়েছে। সেই ছিদ্র দিয়ে বেরোচ্ছে হাজার হাজার গ্যালন জল। একটি হিসাব অনুযায়ী, দীর্ঘ সময় ধরে দৈনিক ৬ থেকে ৭ কোটি লিটার জল সেখান দিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকে। একটা সময় নিঃশেষ হয়ে যায় সেই বিপুল জলভান্ডার। এর ফলে এলাকার যত ছোটখাটো ঝর্না ছিল, সবই যায় শুকিয়ে। জলের বিভিন্ন উৎসেরও একই অবস্থা হয়। আর একেই জোশীমঠের কফিনে শেষ পেরেক হিসাবে অভিহিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের দাবি, ওই বিপুল জলভান্ডার শেষ হয়ে যাওয়ার ফলে এলাকার মাটি শুকিয়ে যায়। তা হয়ে যায় ঝুরঝুরে, ফাঁপা। ফলে পাহাড় ভাঙার ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে থাকা জোশীমঠের ধ্বংসও কার্যত সময়ের অপেক্ষা।
টিবিএম দিয়ে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কারণ হল জোশীমঠের কাছেই তৈরি হচ্ছে ‘বিষ্ণুগড় হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রোজেক্ট’। এনটিপিসির এই প্রকল্পে বাঁধ দিয়ে নয়, ব্যারাজের মাধ্যমে নদীর জলকে পাহাড়ি সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। সেই সুড়ঙ্গ খুঁড়তে গিয়েই বিপত্তির শুরু।
এই প্রসঙ্গে হিন্দি সংবাদপত্র ‘দৈনিক ভাস্কর’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে জুয়োলজিস্ট তথা রানিচৌরির ফরেস্ট্রি বিভাগের প্রধান এসপি সতী বলেছেন, ‘‘জোশীমঠ ভেঙে পড়া পাহাড়ের ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সেই ধ্বংসাবশেষ খুব দ্রুত ধসে পড়ছে। এই ধসে পড়া আটকানোর কোনও উপায় এই মুহূর্তে দেখছি না।’’ উল্টে তাঁর আশঙ্কা, ‘‘খুব দ্রুত এমনও শুনতে হতে পারে, জোশীমঠের ৫০ থেকে ১০০টি বাড়ি ধসে গিয়েছে। তাই এই মুহূর্তে একটাই কাজ করতে হবে, তা হল, জোশীমঠের সমস্ত বাসিন্দাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাঁদের উপযুক্ত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। সত্যি এটাই যে, জোশীমঠকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।’’
তবে এ বারই অবশ্য প্রথম নয়। ধসের দাপটে এর আগেও এক বার জোশীমঠ পরিত্যক্ত হয়েছে। সেই সময় জোশীমঠ ছিল কত্যুরী রাজবংশের রাজধানী। এক হাজার বছর আগের কথা। ইতিহাসবিদ শিবপ্রসাদ ডবরাল তাঁর ‘উত্তরাখণ্ডের ইতিহাস’ বইয়ে লিখেছেন, ধসের কারণে জোশীমঠের সমস্ত বাসিন্দাকে নতুন রাজধানী কার্তিকেয়পুরে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy