ভক্তশূণ্য এ বারের পুরীর রথযাত্রা।—ছবি এএফপি।
জন্মেছি পুরীতে। মন্দিরে বেড়ে ওঠা। এই দিনটার দিকে তাকিয়ে থাকি সারা বছর। তবু এ বারের রথযাত্রা ইতিহাস হয়ে থাকবে। যে রথের রশি এক বার স্পর্শ করতে ধনী-দরিদ্র, নামী-অনামী ভক্তেরা ঝাঁপিয়ে পড়েন, সারিবদ্ধ হয়ে সেই রথ টানছেন শুধু মন্দিরের সেবায়েতরা।
শ্রীমন্দিরের সামনে থেকে গুন্ডিচা মন্দির পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার রাস্তা বড় দাণ্ডের এমন ফাঁকা চেহারা— রথে কখনও কল্পনা করিনি। তবু এ বছর এই পথে রথ টেনে নিয়ে যাওয়ার অভাবনীয় অভিজ্ঞতা ভুলতে পারব না। পিছনের চারটে দিন যে কী উৎকণ্ঠায় কেটেছিল! আমি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পরিবারের কুল-পান্ডা। চার বছর আগে মোদী জগন্নাথ-দর্শনে আসার সময় মন্ত্র পড়ে নিজে ওঁর হাতে প্রদীপ দিয়ে আরতি করিয়েছি। করোনার প্রকোপে মন্দিরে দর্শন বন্ধ হওয়ার পরে বার কয়েক পিএমও-তে ফোন করে কথা বলি। এই দুঃসময়ে রথযাত্রা হওয়াটা কত গুরুত্বপূর্ণ, প্রধানমন্ত্রীকে সেই খবরটা দিতে চাইছিলাম। সুপ্রিম কোর্ট রথযাত্রা বন্ধ করতে বলেছে, শুনেও বিশ্বাস করিনি! তবে আমি নিজে আইনজীবী। তাই সে দিনই সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন করে সিদ্ধান্ত রদ করতে বলি। এর মধ্যে প্রশাসনের তরফে আমারও কোভিড-পরীক্ষা হয়ে গেল। নেগেটিভ! তবু বুঝতে পারছিলাম না, প্রভু কী চান। শেষ পর্যন্ত রথযাত্রা হবে শোনার পরে আনন্দে চোখে জল আসছিল।
আজ সব কিছুই হয়েছে ঘড়ির কাঁটা ধরে। বাধাহীন। প্রায় তিন হাজার সেবায়েতের কোভিড-পরীক্ষা হয়েছে গত দশ দিনে। শুধু এক জন প্রতিহারীর ফল পজ়িটিভ। ওড়িশা সরকারের সম্বলপুরি ডিজ়াইনের মাস্ক পরে রথের কাজে আসার সময়টা এ দিন অলৌকিক মনে হচ্ছিল। যে ভক্তেরা রথের সামনে ঝাঁপিয়ে প্রাণ দিতেও ইতস্তত করেন না, তাঁরা অসাধারণ সংযম দেখিয়ে বাড়িতে থাকলেন। ওঁরা সহযোগিতা না-করলে কী পুলিশ পারত সামলাতে! মুখ্যমন্ত্রীও সঙ্গত কারণেই আসেননি। তবে ঠিক সময়ে পাহুন্ডির পরে পরম্পরা মেনে শঙ্করাচার্য দর্শনে এসেছিলেন। পালকিতে চড়ে গজপতি রাজা দিব্যসিংহ দেবও মাস্ক পরে এলেন। সোনার ঝাড়ুতে রথের পথ ঝাঁট দেওয়া বা ছেরা পহরার কাজ ওঁকে করতে হয়।
আরও পড়ুন: ভক্ত সমাগম নেই, রথে তবু দূরত্ববিধি নিয়ে প্রশ্ন
আজ একটুও বৃষ্টি আসেনি! তেতে ওঠা মাটিতে পা রাখা যাচ্ছিল না। দমকলের গাড়ি বার বার জল দিয়ে রাস্তা ভেজাচ্ছিল। তবু প্রবীণ বড়গ্রাহী সেবায়েত দয়িতাপতি, পূজাপান্ডারাও অতটা রাস্তা হেঁটে গেলেন। অনেক বছর আগে এই বড় দাণ্ডের মাঝে সরদা নদী ছিল। রথ কাঁধে নিয়ে নদী পার করাতেন ভক্তেরা। প্রভুর গুন্ডিচায় পৌঁছতে দু’দিন লেগে যেত। সাধারণত এই রথ ভক্তের ভিড়ে এক দিনে গুন্ডিচায় পৌঁছতেই পারে না। এ বার বিকেল পাঁচটার আগেই তিনটি রথ পৌঁছে গিয়েছে। তা-ও সুপ্রিম কোর্টের কথা মতো এক-একটা রথ এক ঘণ্টার ব্যবধানে ছাড়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন: ‘ভূমিপুত্রের ভরসায় আত্মনির্ভর আমেরিকা’, দুশ্চিন্তা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে
আমরা গোছিকারা প্রভুর বডিগার্ড। এমনিতে নিত্যসেবার মধ্যে প্রভুর ভোগ পৌঁছনোর পরে দেখভাল, খাবার পরে প্রভুকে সুগন্ধি জল, পান দেওয়ার কাজ আমরা করি। আজ রথে উঠে প্রভু ‘লাঞ্চ’ সারলেন। রথের সকালে পাহুন্ডির আগে তিনি খিচুড়ি খেয়েছিলেন। কিন্তু পথে বেরিয়ে লাঞ্চে ভাত খান না। তখন একটু সুখা ভোগ খই, চিঁড়েভাজা বা রাবড়ি, আপেল, কলাটলা ওঁর পছন্দ। লাঞ্চের সময়ে আমি বলভদ্রের রথ তালধ্বজে ছিলাম। ঠাকুরকে সুগন্ধি জল এগিয়ে দিলাম। রথ টানার পুরো সময়টা অবশ্য আমি থাকিনি। ভিড় বাড়ছিল। দূরত্ব বজায় রাখা যেত না। সন্ধ্যায় আবার গুন্ডিচায় গিয়ে রথে ওঁকে প্রণাম করলাম। সত্যি উনিই পারেন!
জগন্নাথ চাইলে, ঠেকাবে কে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy