প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যদি এ বার বিলেতে গিয়েও ঘরোয়া রাজনীতির বিরোধীদের আক্রমণ করেন, কিংবা সংসদ চালানোর প্রশ্নে বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনার দরজা না খুলে সংঘাতের পথে অনড় থাকেন তা হলে অন্য কথা। নইলে সংসদের আসন্ন শীতকালীন অধিবেশন একেবারে অচল করে রাখার মুডে নেই রাহুল গাঁধী।
গত বাদল অধিবেশনে সংসদ এক দিনও চলতে দেব না বলে কার্যত পণ করেছিলেন সনিয়া ও রাহুল গাঁধী। সংসদ চালানোর পক্ষে সওয়াল করে সনিয়ার কাছে বকুনিও খেতে হয়েছিল শশী তারুরকে। কিন্তু রাহুলের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানাচ্ছে, এ বারে ভিন্ন পথ নিতে চলেছেন মা-ছেলে। তা হল, অধিবেশন পণ্ড করার পথে না হেঁটে চলতি অসহিষ্ণুতার পরিবেশ, কাশ্মীরে অশান্তি, ডাল, তেল-সহ খাদ্যসামগ্রীর দাম বাড়া বা নেপালে কূটনৈতিক বিপর্যয়েরমতো বিষয়ে সংসদে প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে কৈফিয়ত তলব করা। তাঁর দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা। পাশাপাশি আর্থিক বিলগুলি পাশ করানোর প্রসঙ্গে অন্তত গঠনমূলক সহযোগিতার বার্তা দেওয়া।
কেন এই পরিবর্তিত লাইন নিতে চাইছেন রাহুল? তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতাদের মতে, বিহার ভোটে ‘মোদী হাওয়া’র মিথ ভেঙে গিয়েছে। জাতীয় রাজনীতিতে এটা একটা মাইলফলক। কিন্তু সময়ের এ-ও দাবি, রাজনৈতিক দলগুলি যেন দায়িত্বশীল আচরণ করে। সংসদ অচল করে রাখলে হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, যে শিক্ষিত সমাজ ও শিল্প মহল অসহিষ্ণু পরিবেশ নিয়ে বিজেপি ও সরকারের সমালোচনা করছেন, তখন তারাই কংগ্রেসের সমালোচনা করবে। উল্টে সহানুভূতি পেয়ে যেতে পারে মোদী সরকার। অরুণ জেটলিরা বলার সুযোগ পাবেন, উন্নয়ন ও সংস্কারে বাধা দিচ্ছে কংগ্রেস। অথচ, সংসদে পণ্য পরিষেবা কর (জিএসটি) বিল পাশ হলেই যে বিনিয়োগে জোয়ার আসবে, রাতারাতি অর্থনীতির চাকা বনবন ঘুরতে শুর করবে, এমন আশা নেই। তবু কংগ্রেসকে দায়ী করার ছুতো পেয়ে যাবেন মোদী-জেটলি।
তাই সহযোগিতার বার্তা দিতে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম আজ বলেছেন, ‘‘জিএসটি বিল নিয়ে কংগ্রেসের আপত্তিগুলি পুরোপুরি নীতিগত। বিজেপির অনমনীয়তা ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী গোঁ ধরে থাকার কারণেই বিলটি পাশ হচ্ছে না।’’
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী জেটলি সম্প্রতি বলেছেন, জিএসটি বিল নিয়ে দরকার হলে তিনি রাহুল গাঁধীর সঙ্গেও আলোচনায় বসতে রাজি। কংগ্রেস সূত্র বলছে, রাহুলের সংকেত পেয়েই চিদম্বরম বোঝাতে চেয়েছেন যে, তাঁর দল জিএসটি বিল নিয়েও সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী। তবে রাহুলের সঙ্গে বসার প্রয়োজন নেই। মনমোহন-চিদম্বরমরা জিএসটি বিলের মূল প্রবর্তক। বিল পাশ করাতে হলে জেটলি অন্তত তাঁদের সঙ্গে বসুন। প্রধানমন্ত্রী যদি সংসদ সত্যিই চালাতে চান, তবে রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা গুলাম নবি আজাদ ও লোকসভায় কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খড়্গেকে ডেকে কথা বলুন।
দশ জনপথের ঘনিষ্ঠ কংগ্রেসের এক নেতা এই সূত্রে বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনার তোয়াক্কা না রেখে একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দৃষ্টান্তও দেন। সংসদের গত অধিবেশন চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ এক দিন সন্ধেয় কংগ্রেস সভানেত্রীকে ফোন করে জানান, নাগা চুক্তি সই হয়ে গেছে! মোদীর ফোন রেখেই বিষয়টি রাহুলকে জানান সনিয়া। রাহুল এর পর মণিপুর, অসম, অরুণাচলপ্রদেশে কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রীদের ফোন করে জানতে পারেন, নাগা চুক্তি সই করার আগে কেন্দ্র তাঁদের সঙ্গেও কথা বলেনি। কংগ্রেসের বক্তব্য, সংসদ চালাতে গেলে মোদীকে এই একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া বা চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাব ছাড়তে হবে।
ললিত-কাণ্ডে সুষমা স্বরাজ ও বসুন্ধরা রাজের ইস্তফার দাবিতে গত বাদল অধিবেশন কংগ্রেস একেবারে অচল করে রেখেছিল ঠিকই। কিন্তু তখন সংসদে তামাম বিরোধীরা একমত ছিলেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুলায়ম সিংহ যাদবরা ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু সনিয়া-রাহুল মনে করছেন, এ বার চাইলেও তৃণমূল বা সমাজবাদী পার্টির পালানোর পথ নেই। অসহিষ্ণুতা নিয়ে বিতর্কে বিজেপি-বিরোধী অবস্থান নিতেই হবে তাদের। ডাল-তেলের দাম বাড়া নিয়েও সরকার-বিরোধী অবস্থান নেওয়া ছাড়া উপায় নেই তাদের। এ সব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৈফিয়ত তলবের ব্যাপারেও মমতা-মুলায়মের দল চুপ করে বসে থাকতে পারবে না। অর্থাৎ আগের বার সংসদ অচল করে রাজনৈতিক লাভের আশা ছিল। কিন্তু এ বার সংসদ চালিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সম্মিলিত সমালোচনার মুখে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাতে দেশ জুড়ে অসহিষ্ণু পরিস্থিতির নিন্দা করে সংসদে কঠোর শব্দে একটি প্রস্তাব গ্রহণেরও চেষ্টা চালানো যাবে।
কিন্তু, এতেও কি সংসদ চলবে?
জবাবে রাজ্যসভায় কংগ্রেসের শীর্ষ সারির এক নেতা বলেন, বিরোধীদের এ বার দু’হাতে লাড্ডু। সংসদ চালাতে মোদী যদি বিরোধীদের সঙ্গে কথা বলেন, রোজ তাঁকে সংসদে এসে বসতে হয়— তাতে তাঁর তথাকথিত অহমিকা তথা ‘ইগো’ চুরমার হবে। তা ছাড়া, সংসদে দাঁড়িয়ে যোগী আদিত্যনাথ, কৈলাস বিজয়বর্গীয় থেকে শুরু করে ভি কে সিংহদের মন্তব্যের কুমন্তব্যের সমালোচনা করতে মোদী বাধ্য হলে, সেটাও হবে রাজনৈতিক ভাবে তাঁর মাথা নোয়ানো। প্রধানমন্ত্রী তা না করলে, সংসদ চলা মুশকিল। তখন তার দায় বর্তাবে সরকারের ওপরেই। বিরোধী বা কংগ্রেসের উপরে নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy