বাড়ি দুলে উঠতেই বুক দুরুদুরু।
বুধবার ভরবিকেলে ভূকম্পের ত্রাসে দিশেহারা হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন বহুতল আবাসনটির বহু বাসিন্দা। সিকিওরিটির লোক এসে আতঙ্কের পারদ আরও চড়িয়ে দিলেন। যাঁরা বেরোননি, তাঁদেরও ধরে-বেঁধে নীচে পাঠালেন। হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে হোঁচট খেলেন কেউ কেউ।
দুলুনি অবশ্য ততক্ষণে থেমে গিয়েছে। রক্ষীরা যুক্তি দিলেন, আফটারশক (ভূকম্প পরবর্তী কম্পন) হতে পারে— এই আশঙ্কায় সকলকে তড়িঘড়ি নীচে নামানো হয়েছে। মিনিট পাঁচ-দশ পরে তাঁরা ঘোষণা করলেন, পরিস্থিতি ‘নিরাপদ।’
হাঁফ ছেড়ে বাসিন্দারা যে যাঁর ফ্ল্যাটে ফিরেছেন। কিন্তু ওই গোটা প্রক্রিয়াটির যৌক্তিকতা সম্পর্কে সংশয় দানা বেঁধেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ভূকম্পের ঠিক কত ক্ষণ বাদে ‘আফটারশক’ হবে, রক্ষীরা তা জানলেন কী ভাবে? কী ভাবে পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যে ওঁরা বুঝে গেলেন যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক? বস্তুত আতঙ্কে তাড়াহুড়ো করে লোকজনকে বার করে আনতে গেলে দুর্ঘটনায় হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকে।
ভূ-বিজ্ঞানীরাও বলছেন, ভূমিকম্প যেমন আগাম আঁচ করা যায় না, তেমন আফটারশকের আভাসও পাওয়া অসম্ভব। কম্পনের পাঁচ মিনিট বাদে আফটারশক হতে পারে। পঞ্চাশ মিনিট বাদেও হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য: আফটারশকের তীব্রতা মূল কম্পনের চেয়ে কম হয়। তাই ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা তুলনায় কম। ‘‘তবে মূল কম্পনে কোনও বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে আফটারশকে তা ভেঙে পড়তে পারে।’’— বলছেন বিপর্যয় মোকাবিলা বিশেষজ্ঞ তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক গুপিনাথ ভাণ্ডারী।
এমতাবস্থায় আফটারশকের ভয়ে পড়িমরি করাকে সে ভাবে সমর্থন করছেন না বিশেষজ্ঞেরা। বিপর্যয় মোকাবিলার সঙ্গে যুক্ত অনেকের পরামর্শ, ভূমিকম্পের সময় যাঁরা দ্রুত বাড়ি ছেড়ে বেরোতে পারেননি, কম্পন থামলে তাঁরা ধীরেসুস্থে বেরোন। কয়েক মিনিটের মধ্যে আফটার শক হবেই, এমন কোনও বাঁধা নিয়ম নেই। আরও জরুরি, কাঁপুনির চোটে বাড়ি বা অফিসের কোথাও ফাটল বা চিড় ধরেছে কি না দেখে ভিতরে ঢোকা। ‘‘কারণ, চার-পাঁচ ঘণ্টা বাদে কিংবা রাতদুপুরে জোরালো আফটারশক হলে ওই ফাটলই বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।’’— হুঁশিয়ারি এক নির্মাণ-বিশেষজ্ঞের। গুপিনাথবাবু বলেন, ‘‘নির্মাণের ক্ষতি খালি চোখে যাচাই করতে সময় লাগলেও তাতে নিরাপত্তা অনেকটা নিশ্চিত হয়।’’
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ভূমিকম্পে ভয় পেয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসাটা মানুষের স্বাভাবিক চরিত্র। দু’-তিন দশক আগেও মাটি কাঁপলে শহরতলি-মফস্সলের লোকজন ফাঁকা মাঠে বা পাড়ার মোড়ে জড়ো হতেন। তাতে প্রাণহানির আশঙ্কা কমতো। কিন্তু শহুরে জনতা মাটির প্রথম ঝটকা খেয়েই যে ভাবে ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে আবাসন চত্বর বা অফিসবাড়ি়র সামনে ভিড় জমান, তাতে কাজের কাজ কতটা হবে, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয়। ‘‘বিশতলা অ্যাপার্টমেন্ট ধসে পড়লে উঠোনে দাঁড়িয়ে বাঁচা যাবে কি?’’— প্রশ্ন এক বিশেষজ্ঞের। তাঁর কথায়, ‘‘বাচ্চা-বুড়ো-মহিলাদের নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে হুড়মুড়িয়ে নামতে গিয়েও বড় অঘটন ঘটতে পারে। এটা মাথায় রাখা দরকার।’’
প্রসঙ্গত, বুধবার বিকেলের ভূমিকম্পের পরে ‘আফটারশকের’ ভয়ে ধর্মতলার এক অফিসের কর্মীরা উল্টো দিকের ফুটপাথে জড়ো হয়েছিলেন। অথচ ওই তল্লাটে ওঁদের অফিসবাড়িটাই সবচেয়ে পোক্ত। তা ছেড়ে বেরিয়ে এসে ওঁরা আরও বড় বিপদের মুখে দাঁড়িয়েছিলেন বলে বিশেষজ্ঞদের একাংশের অভিমত। কারণ, জোরালো আফটারশক হলে সরু রাস্তাটির আশপাশের বা়ড়ি ওঁদের উপরে ভেঙে পড়তে পারত।
তা হলে উপায়?
বিপর্যয় মোকাবিলা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হুড়মুড় করে পালানোটাই বাঁচার পথ নয়। তাতে বিপদ বাড়ার সম্ভাবনা। ওঁদের দাওয়াই— ‘‘পায়ের তলায় মাটি কাঁপলে মাথা ঠান্ডা রেখে সিদ্ধান্ত নিন।’’
ভূমিকম্প হলে
• বাড়ির ভিতরে থাকবেন না
• অযথা তাড়াহুড়ো করবেন না
• দাঁড়াবেন ফাঁকা জায়গা দেখে
• সরু গলি, গাছের তলা বিপজ্জনক
• কার্নিসের তলায় দাঁড়ালেও ঝুঁকি
• ভুলেও লিফ্টে চড়তে যাবেন না
• বাড়িতে ঢোকার আগে সাবধান
• দেখে নিন, বাড়ির অবস্থা কেমন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy