বহু ইতিহাসের সাক্ষী গৌরীপুর রাজবাড়ি। রয়েছেন লালজি-পুত্র প্রবীর বরুয়া। — নিজস্ব চিত্র।
হাত ও হাতির উপরে ভরসা রেখে লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত হাতে পদ্মই তুলে নিলেন গৌরীপুর রাজবাড়ির পঞ্চদশ পুরুষ। এক সময় দেশ-বিদেশের তাবড় রাজা-জমিদার, ইংরেজ কর্তা, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পছন্দের ঠিকানা ছিল গৌরীপুর রাজবাড়ি। আপাতত অতীত-স্মৃতি আঁকড়ে ধুঁকছে রাজবাড়ি। পুনর্বাসন সংক্রান্ত জট না খোলায় রাজবাড়িকে ‘হেরিটেজ বিল্ডিং’ হিসেবেও ঘোষণা করা হয়নি। রাজবাড়ির বৈঠকখানায় বসে বর্তমান বংশধর প্রবীর বরুয়া তাই আক্ষেপ করেন, “পুনর্বাসনের তাগিদে বাধ্য হয়েই রাজনীতিতে নাম লেখাতে হল।”
কিন্তু শাসক দলে না এসে কেন বিজেপিতে গেলেন প্রবীরবাবু? কারণ খুঁজতে পিছনে তাকাতে হবে। ইংরেজদের প্রিয়পাত্র, গৌরীপুর রাজপরিবার বরাবরই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ছিল। এমনকী নেতাজিকে হাওয়াখানার গুপ্তকক্ষে লুকিয়ে রেখে বাবা প্রভাতচন্দ্র বরুয়ার ধমক খেয়েছিলেন প্রকৃতিশ চন্দ্র বরুয়া।
প্রবীরবাবু জানান, তাঁদের পূর্বপুরুষ নরহরি রায় মুজফ্ফরপুর থেকে প্রথম কামাখ্যায় আসেন। কোচ রাজা বিশ্ব সিংহ তাঁকে কোচ রাজত্বে নিয়ে এসে বরুয়া উপাধি দেন। তাঁর উত্তরপুরুষ কবীন্দ্র পাত্রকে প্রধানমন্ত্রী করেন রাজা নরনারায়ণ। পরবর্তীকালে নরনারায়ণের ভাইপো, চিলারায়ের ছেলে রঘুদেব ও নরনারায়ণের পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণের মধ্যে সিংহাসন দখলের লড়াই শুরু হলে রঘুদেব ও কবীন্দ্র রাঙামাটির দিকে চলে আসেন।
লক্ষ্মীর বিরুদ্ধে সাহায্যের আবেদন চেয়ে মুঘল-সম্রাট জাহাঙ্গীরের দ্বারস্থ হয়েছিলেন কবীন্দ্র। কথিত আছে, তখনই জাহাঙ্গীর কবীন্দ্রকে রাঙামাটির নায়েব-কানুনগো হিসেবে নিযুক্ত করে একটি গড়গড়া উপহার দেন। যার বর্তমান মূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় বিশ কোটি টাকা। আপাতত নিলামে ওঠা গড়গড়াটি কলকাতা হাইকোর্টের হেফাজতে রয়েছে।
বরুয়া পরিবার পরবর্তীকালে কানুনগো থেকে ‘রাজা’ হয়। রাজধানী হয় গৌরীপুর। তবে প্রভাতচন্দ্র বরুয়াই ধুবুরি-গৌরীপুরকে কোচবিহারের আদলে গড়তে উদ্যোগী হন। গড়ে ওঠে রাজ-হাউলি, হাওয়াখানা, শিসমহল, তাজমহল, আঠারোকোটা প্রসাদ। তৈরি হয় সড়ক, কাটানো হয় বড় বড় দিঘি, বাগান। তিনিই প্রথম ‘পূর্ত দফতর’ গড়েন। রাজ্যের বিভিন্ন খাতে ব্যয়বরাদ্দের প্রথা চালু করেন। মোট খরচের ৫২ শতাংশ শিক্ষাক্ষেত্রে, জনস্বাস্থ্যে ১৬ শতাংশ, দানে ১২ শতাংশ, পানীয় জল যোগানে ২ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছিল।
তাঁর পুত্র প্রকৃতিশ বরুয়া বা লালজি ছিলেন নামকরা শিকারি ও হাতি বিশেষজ্ঞ। ১১১টি চিতাবাঘ, ৬৫টি বাঘ মেরেছিলেন তিনি। রাজ্যে ৬৫১টি ও রাজ্যের বাইরে ৩৫০টি হাতি ধরেন। দেশ-বিদেশের অনেক অতিথি লালজির ‘হাতি শিবিরে’ অংশ নিতে হাওয়াখানায় আসতেন।
লালজির ভাই প্রমথেশ চন্দ্র বরুয়া শুধু পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতাই ছিলেন না, ছিলেন নামকরা শিকারি এবং অসম আইনসভায় স্বরাজ্য পার্টির চিফ হুইপও। প্রকৃতিশের এক মেয়ে পার্বতী বরুয়া। বাবার হাতি বশ করার ধারা বজায় রেখেছিলেন তিনি। অপর কন্যা প্রতিমা পাণ্ডে বরুয়া তো ছিলেন গোয়ালপারিয়া গানের কিংবদন্তী শিল্পী।
পার্বতী ও প্রতিমাদেবীর ভাই, লালজির পুত্র প্রবীরবাবুই এখন রাজবাড়ির রক্ষক। গদাধর নদীর পাশে হাওয়াখানার দোতলায় বসে বাবার দিনলিপি খুলে প্রবীরবাবু জানান, এক সময় রাজবাড়িতে ছিল বিরাট চিড়িয়াখানা। এই হাওয়াখানায় উত্তমকুমার থেকে মুনমুন সেনরা এসে থেকেছেন। হয়েছে বিচারক, গজমুক্তা-সহ অনেক ছবির শুটিং। এখন প্রতিমাদেবীর স্বামী ও প্রবীরবাবুর পরিবার এই বাড়িতে থাকেন। একতলার সংগ্রহশালার ভগ্নপ্রায় দশা। সেখানে এখনও লালজির মারা বাঘ, কালো চিতাবাঘ, বুনো মোষ আর প্রমথেশ বরুয়ার মারা গন্ডারের মাথা রয়েছে। চুরি গিয়েছে সব হাতির দাঁত।
অর্থাভাবে বাড়ির ঐতিহ্য বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না বলে স্বীকার করেন প্রবীরবাবু। তাঁর কথায়, “প্রফুল্ল মহন্ত মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে তাঁকে রাজবাড়ি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দিই। কিন্তু তিনি এতগুলি বাড়ি, সম্পত্তির বিনিময়ে এবং আমাদের পুনর্বাসনের জন্য ২৫ লক্ষের বেশি টাকা দিতে রাজি ছিলেন না। কংগ্রেস আমলেও প্রস্তাব গিয়েছে রাজবাড়ির তরফে। লাভ হয়নি।” তিনি জানান, জমিদারি যাওয়ার সময় সরকার বছরে চার হাজার টাকা দিত, এখন তা বেড়ে আট হাজার হয়েছে। অথচ রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর খরচই তার ১০ গুণ বেশি। মান বাঁচাতে চাঁদা তুলে পুজো করার কথাও ভাবতে পারেন না প্রবীরবাবুরা। লালজির আমলে রাজবাড়িতে যেখানে ৪২টি হাতি ছিল, সেখানে বরুয়াদের শেষ দু’টি হাতি এখন মানস জাতীয় উদ্যানে ‘কাজে’ লাগানো হচ্ছে।
প্রবীরবাবুর কথায়, স্বাধীনতার পরে কংগ্রেস প্রকৃতিশ চন্দ্র বরুয়াকে দলে টানতে চেয়েছিল। কিন্তু লালজি নির্দল বিধায়ক হলেও কংগ্রেসে যোগ দেননি। পরে মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চলিহা তাঁকে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিলেও লালজি জানান, ‘রাজা’ হয়ে তিনি মন্ত্রির পর্যায়ে নামতে পারবেন না।
সঠিক সময় ক্ষমতার হাত না ধরার মাসুল দিচ্ছেন প্রবীরবাবুরা। তিনি মেনে নেন, সব দলের সরকারের কাছেই রাজ পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যাপারে আবেদন করে তিনি হতাশ। স্থানীয় সাংসদ বদরুদ্দিন আজমল তাঁর বাড়িতে এসে অভিযোগের কথা শুনে চিঠি লেখেন জেলাশাসককে। প্রবীরবাবু বলেন, “সে চিঠি জেলাশাসককে দেখাতেই তিনি জানান, প্রতিশ্রুতির চিঠির পাহাড় জমে রয়েছে।”
প্রদেশ বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্যের বাবার সঙ্গে লালজির ছিল পারিবারিক সম্পর্ক। সেই সূত্রে সিদ্ধার্থবাবুই প্রবীরবাবুকে বিজেপিতে টেনে এনেছেন। প্রবীরবাবুর কথায়, “সিদ্ধার্থের কথায় আর নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিত্ব দেখে বিজেপিতে এলাম। দেখি কী হয়?” আর বিজেপির প্রাপ্তি? গৌরীপুর রাজবাড়ির প্রভাব এখনও এই এলাকায় বিশাল। সেই পরিবার সঙ্গে থাকা মানে ভোটে বাড়তি সুবিধা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy