Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
National News

টাকা ছাই, নাহি চাই, পেটিএমে বিড়ি কিনছে চাষি, চাষির বউ সিঁদুর

বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী সাংবাদিক বৈঠকে আশার বাণী শোনালেন। নগদ টাকা ব্যবহার বন্ধ করলে নানা ছাড় পাওয়া যাবে। এত দিনে সরকারের মাথায় সুবুদ্ধি এসেছে। তবে আমরা তো আম জনতা। আমাদের মাথায় অত বুদ্ধি আসবে কোথা থেকে।

দীপংকর দাশগুপ্ত, অর্থনীতিবিদ
শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৬ ১৩:২১
Share: Save:

বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী সাংবাদিক বৈঠকে আশার বাণী শোনালেন। নগদ টাকা ব্যবহার বন্ধ করলে নানা ছাড় পাওয়া যাবে। এত দিনে সরকারের মাথায় সুবুদ্ধি এসেছে। তবে আমরা তো আম জনতা। আমাদের মাথায় অত বুদ্ধি আসবে কোথা থেকে। তাই অদ্ভুত সব প্রশ্ন জাগছে। যদি নগদে দেনা পাওনা তুলে দেওয়ারই ইচ্ছে ছিল তবে আবার নতুন টাকা ছাপার যজ্ঞ কেন একই সঙ্গে শুরু হয়েছে। রোজই শোনা যাচ্ছে যে আর মাত্র কটা দিন, তার পরেই সব কিছু যেমন ছিল তেমনই চলবে। অর্থাৎ এটিএমে চাইলেই টাকা পাওয়া যাবে, ব্যাঙ্কে আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না প্রত্যহ ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যদি নগদ ব্যবহার করা বন্ধ করাই সরকারের উদ্দেশ্য হয়, তবে পাড়ার ফুচকাওয়ালার হাতে পেটিএম বা ওই জাতীয় কিছু যন্ত্র ধরিয়ে দিচ্ছে না কেন? ব্যাপারটা এতই জটিল যে কারও পক্ষেই অর্থ বোঝা দায়।

বাড়ির কাজের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম- কি রে? কিছু বুঝলি? দু’হাজার টাকার জিনিস কিনলে তোকে আর পরিষেবা কর দিতে হবে না। গাধাটা আমায় জিজ্ঞেস করল- কেন? আমার ট্রেনের মান্থলি কিনতে তো দু’হাজার টাকা লাগে না। আমি বোঝালাম- আরে ট্রেনের মান্থলি কিনলেও ছাড় পাবি। সে তো শুনে আহ্লাদে আটখানা। বলে- আমার তো কালকেই কিনতে হবে। আমি বললাম- ভাল, কার্ডটা নিয়ে যাস। সে অবাক হয়ে বলল- কার্ড তো নিতেই হবে। ওটা বদলেই তো নতুন কার্ড দেবে। ধৈর্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছে আমি বললাম- আরে ওই কার্ডের কথা কে বলছে? তোর ব্যাঙ্কের কার্ড নিয়ে যাবি। পিন নম্বরটা ভুলে যাস না যেন। চোখ গোল করে সে বলল- পিন নম্বর আবার কী? নম্বর টম্বর জানিনে বাপু। আমায় লিখে দিও, ওদের বলব। ওরা পড়ে দেবে। আমি লাফিয়ে উঠে বললাম- আরে গাধা, পিন নম্বর কাউকে বলতে হয় না। সে বলল- কেউ না জানলে আমি জানব কী করে? আমি আর তর্ক করলাম না। কেবল বললাম- সরকার এত সুবিধা করে দিল, আর তুই সব নষ্ট করলি। পরিষেবা কর বলে কথা। ও আরেকটা কী যেন বলল- পরিষেবা কর কী?- এই জাতীয় কিছু। আমি দেখলাম ওকে বোঝনোর চেয়ে আমি নিজে গিয়ে বরং ভজহরি মান্নাতে ভাল মন্দ খেয়ে পরিষেবা কর বাঁচাই।

রাস্তায় বেরোতেই সেই অতি পরিচিত বুড়ির সঙ্গে দেখা। সরকার নানা ছাড় দিলেও সে আমাকে ছাড় দেয় না। ওকে কিছু না দিলে নিস্তার নেই। এ দিকে আমার পকেট তো গড়ের মাঠ। যদিও আমার পেটিএম অ্যাকাউন্টে টাকা আছে। ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ডও সঙ্গে মোতায়েন। আমি বললাম পেটিএমে দিলে চলবে? কিংবা এটিএম? শুনে তো সে মারতে এল, মানে ঐ গরিব গুরবোরা যেমন করে আর কী। যাদের উন্নয়নের জন্য সরকার এত চিন্তিত। আমি তো পালিয়ে বাঁচি। ভাগ্যিস একখানা অটো যাচ্ছিল। চট করে সেটায় চড়ে বসলাম। কিন্তু তার পরেই মনে হল- সর্বনাশ করেছে রে! ওকে পেটিএম দিয়ে খুশি করা যাবে তো? জিজ্ঞেস করার সাহসেই কুলোচ্ছে না। হেন কালে মনে পড়ল পকেট একটা পাঁচ টাকার কয়েন আছে। ঠাকুরকে ডেকে বললাম খুব বাঁচা বাঁচিয়েছ বাবা বিশ্বনাথ। আরেকটু হলেই গাড্ডায় পড়েছিলাম আর কী!

কী কাণ্ড রে বাপ! পকেট ভর্তি এটিএম, পেটিএম, কিন্তু সব কটা অচল। অবশ্য পার্ক হোটেল গেলে কোনও ভয় নেই। ওরা তো হাসি মুখে আমার পুরো পেটিএমখানাই গিলে নেবে। কেবল মিনি বাসওয়ালাটাই যত ঝঞ্ঝাট বাঁধায়। এ যেন কেমন এক আজব দেশ। এক দিকে টাকা ছাপিয়েই চলেছে, অন্য দিকে বলছে ঐ ছাপানো টাকার কোনও প্রয়োজনই নেই। তবে এত খরচাপাতি করে টাকা ছাপছে কেন রে বাবা? সরকারের পকেটে কি অনেক রসদ? সরকারের কি টাকা ছাপানো ছাড়া আর কোনও খরচা নেই?

যদি ক্যাশলেস অর্থনীতিই আমাদের গন্তব্য হয় তবে ইস্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের গ্রামে গঞ্জে পাঠিয়ে মোবাইল ফোনের উপকারিতা শেখালেই তো হয়। সরকারের নোট ছাপানোর খরচা কমে আর ছেলেমেয়েগুলোরও একটু রোজগারপাতি হয়। তবে সকলের হাতে তো ফোনটাও তুলে দিতে হবে। সে খরচাও আছে। কে বলতে পারে জনদরদী সরকার এবার কী করবে? দিনে সাড়ে তিনবার করে যে সরকারের মত বদলায়, সে সরকার আগামী কাল কী করবে সে তো সরকার নিজেই জানে না।

তবে ধরে নেওয়া যাক সেই স্বর্ণযুগ এসে উপস্থিত। দেশ থেকে কাগুজে টাকা উঠে গিয়েছে। চাষি তার বিড়ি কেনে পেটিএম দিয়ে। চাষির বউ সিঁথির সিঁদুর কেনার দাম দেয় এটিএম কার্ড দিয়ে। গ্রামে গ্রামে এত ব্যাঙ্ক যে চাষের জমিতে টান পড়েছে। জাতীয় রোজগার যোজনার টাকা জমা পড়ে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। কারও ট্যাঁকে টাকার ট-ও নেই। হেনকালে জানা গেল ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট থেকে কে বা কারা চাষির টাকা হাপিশ করে দিয়েছে। তাদের কী যেন নাম। হ্যাকার? তার মানে কি? তা মানে যাই হোক না কেন, আসল কথা হল অ্যাকাউন্টে টাকা নেই। কেন নেই কেউ জানে না। আর গ্রামের চাষিই বা কেন, শহুরে বাবুরও রক্ষা নেই। হয়তো তিনি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাষ্টার মশাই। অক্ষর জ্ঞান নেই এমন নয়। তিনি হঠাৎ দেখেন তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে ৭৫ হাজার টাকার কেনা কাটা হয়ে গিয়েছে। তখন তিনি ছুটলেন ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের কাছে। ভিড় ঠেলে যত ক্ষণে ম্যানেজারের ঘরে পৌঁছলেন তত ক্ষণে আরও ৩৩ হাজার বেরিয়ে গিয়েছে। ম্যানেজার ভদ্রলোক। তাই তিনি বাঁচার এক মাত্র রাস্তা বাতলে দেন। স্যার, আপনি এক্ষুনি এই অ্যাকাউন্টটা বন্ধ করে দিন। নইলে আপনার বাঁচার কোনও উপায় নেই। কিন্তু ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করলে তো পেটিএম ব্যবহার করা যাবে না! তবে তো টাকা নিয়ে বাড়িতে রাখতে হবে। আর কাগজের টাকা ধরা পড়লেই তো আয়কর বিভাগ হিসেব চাইবে। এ টাকা কোথা থেকে এল? ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে সেই কথা জানানোতে তিনি একটু মাথা চুলকে বললেন -- তাই তো! আপনাকে বাঁচাই কী করে? আপনি বরং এক কাজ করুন। আপনি মরে যান। এমন কিছু শক্ত কাজ নয়। দেশ জুড়ে কত লোকই তো এটিএমের লাইনে দাঁড়িয়ে ধুপধাপ পড়লেন আর মরলেন।

একটু ভেবে দেখুন পাঠক পাঠিকারা! আপনার ক্যাশকার্ডের প্রতি আকর্ষণ মৃত্যুর চেয়েও বেশি? লজ্জা করে না? দেশকে ক্যাশলেস করার জন্য আপনার সামান্য প্রাণটুকুও আপনি ত্যাগ করতে পারেন না? ছিঃ!

আরও পড়ুন: এক মাসে বদলে গেল চাঁদমারিই! কালো টাকা নিয়ে এখন মুখে কুলুপ

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE