ভারতের হামলার আশঙ্কায় নিয়ন্ত্রণ রেখার ও ধারে অস্ত্র শানিয়ে গা-ঘামাচ্ছে পাক সেনারা। সীমান্ত পেরিয়ে ঢোকা জঙ্গিদের মোকাবিলা করে ক্লান্ত ভারতীয় সেনারা বলছে— মুখে শান্তির বুলি, কিন্তু ছায়াযুদ্ধ দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। দুঃসহ এই অবিশ্বাসের মধ্যেও উত্তেজনা প্রশমনের উপায় নিয়ে সওয়াল করছেন নয়াদিল্লিতে পাকিস্তানের হাই কমিশনার আব্দুল বাসিত। বলছেন, আশার কথা হল দু’দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টারা কথা শুরু করেছেন। এর পরে বিদেশসচিবেরাও বসুন। সপ্তাহ দুই আগেও প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সুরে কাশ্মীরে গণভোট দাবি করলেও আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তা নিয়ে উচ্চবাচ্যই করলেন না
আব্দুল বাসিত।
প্রশ্ন: অনেকে বলছেন, উরির হামলার পর যুদ্ধ বা শান্তি— এই দুইয়ের বাইরে কোনও বিকল্প থাকতে পারে না। দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র কি লড়াই বাধাবে? না কি ফের শুরু হবে শান্তি আলোচনা?
বাসিত: তৃতীয় একটি রাস্তাও রয়েছে। মুখ দেখাদেখি সম্পূর্ণ বন্ধ করে বসে থাকা! যাকে বলে, ‘টোটাল ডিজ়এনগেজমেন্ট’। কিন্তু কূটনীতিক হিসেবে আমি মনে করি, সেটা একান্তই মূর্খের পথ। সারা ক্ষণ একটি শত্রুতার আবহে বসবাস করব, এটা কোনও বিকল্প হতে পারে না। দু’দেশের পক্ষেই এ’টা ধংসাত্মক পথ হবে। আজ যদি আলোচনার টেবিলে কাশ্মীর সমস্যা মিটে যায়, দুটো দেশের সম্পর্ক এতটাই সৌহার্দের হয়ে উঠবে, ভারত-পাকিস্তানের নেতারাও সেটা ভাবতে পারবেন না।
প্রশ্ন: শপথ গ্রহণের পরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু উরির এই হামলার পর পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে শান্তি প্রক্রিয়া কি আর চালানো সম্ভব?
বাসিত: শুধু প্রতীকী কর্মসূচি নিলে কাজের কাজ কিছু হয় না। আবার একে অপরকে যদি দোষারোপই করতে থাকি, তা হলেও কোনও দিন সমাধানে পৌঁছনো যাবে না। এই ‘আমরা-তোরা’ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটা এক ধরনের একগুঁয়েমি। ’৪৮, ’৬৫, ’৭১ এবং ’৯৯-এর কারগিল— আমরা চার চারটি যুদ্ধ লড়েছি। ২০০৭ সালে সমঝোতা এক্সপ্রেসের বিস্ফোরণে ৪২ জন পাকিস্তানি মারা গিয়েছিলেন। আবার মুম্বই হামলায় প্রাণ হারান ১৬৬ জন। এর পর পঠানকোট, উরি— একের পর এক সংঘাত। দু’দেশের মধ্যে আস্থা আর বিশ্বাসের এই খামতিটাকে দূর করতে হবে। পুরনো ঘটনাগুলি নিয়ে আপনারা যেমন তদন্ত করছেন, আমারাও তদন্ত করছি। আপনারা বলছেন, ভারতকে অস্থির করার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা বলছি, পাকিস্তানকে টুকরো করার চক্রান্ত হচ্ছে। অথচ আমাদের উচিত বিশ্বায়নের সুযোগ সুবিধা কাজে লাগিয়ে এগিয়ে চলা।
প্রশ্ন: শরিফ হয়তো চাইছেন, কিন্তু পাক সেনা কি শান্তির পথে এগোতে দেবে? এটা কিন্তু অধিকাংশ ভারতীয়েরই প্রশ্ন। পাকিস্তানের সংবাদপত্রেও লেখা হচ্ছে— উরির হামলা ও তার পরে নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ভারতের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর পরে শরিফের সঙ্গে চূড়ান্ত সংঘাত চলছে সেনাবাহিনীর।
বাসিত: দেখুন পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির উপরই ভারতকে আস্থা রাখতে হবে। আমাদের নির্বাচিত ব্যবস্থার শীর্ষে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে ভারতে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। এই মুহূর্তে পশ্চিম সীমান্তে বড়সড় সন্ত্রাসের মোকাবিলায় লড়তে হচ্ছে পাকিস্তানি বাহিনীকে। তাই সেনারাও চায় ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক ভাল হোক, উত্তেজনা প্রশমন হোক। এত বড় সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বিপুল। পাকিস্তান আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ না হলে সেনারই লোকসান। আবার পাক সেনা সম্পর্কে পুরনো ধ্যান-ধারণা ভারতকে বদলাতে হবে। শুধু ঘরোয়া রাজনীতি ও নির্বাচনী বাধ্যবাধকতার নিরিখে ভারতের পাকিস্তান-নীতি নির্ধারিত হওয়াটা উচিত নয়। শান্তি স্থাপনের দায়িত্ব ভারতকে নিতে হবে। দুই প্রতিবেশী দেশ গত সত্তর বছর ধরে লড়াই করে যাচ্ছে! এ বার আমরা যদি শান্তির বাতাবরণ তৈরি করতে পারি, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সেটা দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।
প্রশ্ন: এত তপ্ত আবহাওয়ার মধ্যেও দু’দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টারা আলোচনা শুরু করেছেন। এ বিষয়ে আপনি কী বলেন?
বাসিত: অবশ্যই ইতিবাচক পদক্ষেপ। আলোচনার দু’টি ধারা আছে। একটি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্তরে। আর একটি বিদেশসচিব স্তরে। স্থগিত হয়ে যাওয়া বিদেশসচিবদের আলোচনাও এ বার শুরু হোক। সন্ত্রাস নিয়েও আমরা আলোচনা করব। শুধু কাশ্মীর নয়, আমরা সমস্ত বিষয় নিয়ে সুসমন্বিত আলোচনা চাইছি। লুকোছাপা করাটা অর্থহীন। যৌথ ঘোষণা, সিমলা চুক্তি, লাহৌর চুক্তি, ২০১৬-য় ইসলামাবাদের যৌথ বিবৃতি— সবেতেই কাশ্মীর সমস্যার কথা স্বীকার করা হয়েছে। বুরহান ওয়ানির অন্ত্যেষ্টিতে যে হাজার হাজার লোক সমাগম হয়েছিল, তার পর বিক্ষোভ, তা দমন করতে গিয়ে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি— কাশ্মীরের মানুষের কণ্ঠস্বর তো আমরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারছি। আমি বলতে চাইছি, সেটাকে মেনে নিয়ে এগোলে দু’দেশের আস্থা মধ্যে বাড়ানোর প্রক্রিয়াটা আরও দ্রুত হতে পারে।
প্রশ্ন: বলা হচ্ছে, বেশ কয়েকটি দেশ বয়কট করায় পাকিস্তান সার্কে একঘরে হয়ে পড়েছে।
বাসিত: না, এটা একেবারেই ঠিক নয়। মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমরাই প্রধান যোগসূত্র। একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে উঠে আসছে পাকিস্তান। বিশ্ব আমাদের সঙ্গে রয়েছে। সুতরাং আমরা কখনওই নিজেদের বিচ্ছিন্ন বলে মনে করি না। পাকিস্তান নিঃসঙ্গ নয়। সকলেই আমাদের পাশে রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy