(বাঁ দিক থেকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অখিলেশ যাদব এবং রাহুল গান্ধী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তৃতীয় নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। প্রাথমিক ভাবে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় বাজেটে বিহার এবং অন্ধ্রপ্রদেশের একাধিক প্রকল্পের জন্য বিপুল অঙ্কের টাকা বরাদ্দ করার ঘোষণা করা হয়েছে। আর এই বিষয়টিকে সামনে রেখেই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সুর চড়াল বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র দলগুলি। বিরোধী দলগুলির বক্তব্য, লোকসভায় সংখ্যালঘু বিজেপি কেন্দ্রে সরকার বাঁচানোর স্বার্থেই দুই শরিক দলকে আর্থিক অনুদান দিয়ে তুষ্ট করতে চেয়েছে। প্রসঙ্গত, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এবং অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডু শাসকজোট এনডিএ-র গুরুত্বপূর্ণ দুই শরিক।
রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল দুই শরিক দল জেডিইউ এবং টিডিপিকে ‘ঘুষ দেওয়ার’ অভিযোগ তুলেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। বাজেট ঘোষণার পরেই তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করেন, “এটি একটি ব্যর্থ বাজেট। ব্যর্থ সরকারের ব্যর্থ অর্থমন্ত্রীর পেশ করা এই বাজেটের কোনও গ্যারান্টি নেই।” একই সঙ্গে ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল সাংসদের সংযোজন, “বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির মতো জরুরি বিষয়গুলি মোকাবিলা করার পরিবর্তে বিজেপি শরিক দলগুলিকে ঘুষ দেওয়ার জন্য বাজেট তৈরি করেছে।” প্রায় অভিষেকের সুরেই এসপি নেতা অখিলেশ যাদবের তোপ, ‘‘এটি সরকার বাঁচানোর বাজেট।’’ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “এটা ভাল যে, সরকার বিহার এবং অন্ধ্রের জন্য বিশেষ প্রকল্প ঘোষণা করেছে। কিন্তু অন্য রাজ্যগুলির কথাও ভাবা উচিত সরকারের।”
লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী এই বাজেটকে ‘কুর্সি বচাও বাজেট’ বলে কটাক্ষ করেছেন। এক্স হ্যান্ডলে রায়বরেলীর কংগ্রেস সাংসদ লেখেন, “শরিকদের তুষ্ট করার বাজেট।” একই সঙ্গে তাঁর দাবি, পুঁজিপতিদের একাংশকে সুবিধা করে দিলেও সাধারণ মানুষদের সুরাহার দিকে নজর দেওয়া হয়নি এই বাজেটে। এই প্রসঙ্গে রাহুল ইংরাজিতে দুই ‘এ’র প্রসঙ্গ টানেন। কংগ্রেসের অন্দরের অনেকে মনে করছেন, দুই ‘এ’ বলতে তিনি শিল্পপতি মুকেশ অম্বানি এবং গৌতম আদানির পদবির আদ্যাক্ষরের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। আবার বাজেটে কর্মসংস্থান সংক্রান্ত ঘোষণাকে ‘কংগ্রেসের ইস্তাহারের অনুকরণ’ বলে কটাক্ষ করেন দলের প্রবীণ নেতা তথা প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম।
দেশের পূর্ব দিকের উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়ার কথা বলা হলেও পশ্চিমবঙ্গকে বন্যারোধ কিংবা অন্যান্য পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রে কোনও টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হল না কেন, এই প্রশ্ন তুলে সরব হয়েছে তৃণমূল। শরিকি বাধ্যবাধকতার জন্য কেবল দু’টি রাজ্যকে আর্থিক সুবিধা দিয়ে কেন ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আঘাত’ করা হবে, সেই প্রশ্নও উঠছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন কেন্দ্রীয় বাজেট নিয়ে বলেছেন, ‘‘একটা সরকার স্পিকার পদ বা মন্ত্রিত্ব না দিয়ে কেবল শেয়ারে দুর্নীতি করে এবং অর্থ দিয়ে শরিকদের হাতে রাখছে। শরিকেরাই বা কেন এটা গ্রহণ করছে, আমার জানা নেই। অন্ধ্র বা বিহারকে টাকা দেওয়ায় আমার আপত্তিও নেই। তারাও আমাদের দেশের মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু এক জনকে দিতে গিয়ে আর এক জনকে বঞ্চনা করা যায় না।’’
বাজেটে ‘মনরেগা’ বা ‘১০০ দিনের কাজ’ নিয়ে উল্লেখ না থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিরোধী দলগুলি। তিরুঅনন্তপুরমের কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুর সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “বাজেটে অনেক কিছুরই উল্লেখ নেই। এমনকি ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের কথাও বলা হল না। দেশের প্রান্তিক স্তরে থাকা ৪০ শতাংশের উপার্জন বৃদ্ধির কোনও দিশা এই বাজেটে নেই।”
বিহার এবং অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য ‘বিশেষ’ মর্যাদাযুক্ত রাজ্যের তকমা আদায় করতে মরিয়া ছিলেন নীতীশ এবং চন্দ্রবাবু। পাশে থাকার জন্য মোদীকে কিছু বিশেষ শর্ত দিয়েছিলেন তাঁরা। রাজ্যের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজের দাবি ছিল দু’জনেরই। এ বারের বাজেটে যেন তারই প্রতিফলন দেখা গেল। বিহারের জন্য যেমন নতুন বিমানবন্দর, সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, মেডিক্যাল কলেজ, ক্রীড়া পরিকাঠামো তৈরি করতে বিশাল অঙ্কের টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, তেমনই চন্দ্রবাবুর স্বপ্নপূরণের জন্যও টাকা দেওয়ার কথা বলা হল এ বারের বাজেটে।
বিহারের সড়ক যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে এ বারের বাজেটে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বলেন, “বিহারের বেশ কয়েকটি এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে। পটনা-পূর্ণিয়া, বক্সার-ভাগলপুরের ভিতর এক্সপ্রেসওয়ে উন্নয়ন করা হবে। এ ছাড়াও বুদ্ধগয়া, রাজগির, বৈশালী এবং দ্বারভাঙাতে এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই খাতে মোট ২৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে সরকার।” এ ছাড়াও বিহারে নতুন সেতু নির্মাণ করা হবে বলেও জানানো হয়েছে বাজেটে। বক্সার জেলায় গঙ্গার উপর দুই লেন বিশিষ্ট সেতু তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, ভাগলপুরে ২৪০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করা হবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, ‘‘উন্নয়নের জন্য বেশি ঋণ নিতে পারবে বিহার সরকার।’’
এখানেই শেষ নয়, বিহারের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য বিশেষ ঘোষণা মোদী সরকারের। ভারতকে বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে শীর্ষে তুলে ধরার কথা জানান অর্থমন্ত্রী। সে কারণে যে সব প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে তার অধিকাংশ প্রকল্পই যেতে চলেছে বিহারে। নতুন করে সাজানো হবে বুদ্ধগয়া, রাজগির এবং নালন্দাকে। এ ছাড়াও, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য ১১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আর্থিক সহয়তার কথা বলা হয়েছে এই বাজেটে। পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মোদী সরকার ‘পূর্বোদয়’ প্রকল্পে উদ্যোগী হয়েছে। সেই উদ্যোগের অন্যতম অংশ হল বিহার।
বিহারের পর অন্ধ্রপ্রদেশ। এ বারের লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে অন্ধ্রের বিধানসভা নির্বাচনও হয়েছিল। সেই নির্বাচনে জগন্মোহনের দলকে হারিয়ে জয় পায় চন্দ্রবাবুর টিডিপি, বিজেপি এবং পবন কল্যাণের দল জনসেনার জোট। আবারও মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে ফেরেন চন্দ্রবাবু। ফিরেই অমরাবতীকে রাজ্যের রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করেন তিনি। কিন্তু এই শহরের পরিকাঠামো তেমন উন্নত নয়। এ বারের বাজেটে চন্দ্রবাবুর সেই স্বপ্নই পূরণ করল কেন্দ্র। রাজধানী অমরাবতী গড়ে তোলা ও অন্যান্য পরিকাঠামোর জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা ঘোষণা করা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy