ফাইল ছবি
ঔপনিবেশিক আইনগুলি কেনই বা বহন করল স্বাধীন ভারত?— প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন ইতিহাসবিদ তনিকা সরকার। তাঁর কথায়, “এ দেশের সংবিধান স্রষ্টারা কেন রাষ্ট্রদ্রোহ আইনকে রেখে দিয়েছিলেন? ১৯৬০-এর পরে ক্রমশ ওই আইনের প্রভাব বেড়েছে। সব দল সব রাজ্যে এর প্রয়োগ করেছে। আগে ইউএপিএ-র মতো আইনও তো ছিল না!’’ কখনও আফস্পা, তো কখনও অন্য কোনও ‘জুলুমবাজির’ আইন দশকের পর দশক ভারতের বুকের উপরে চেপে বসে থেকেছে বলে তাঁর অভিযোগ।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) একদা উমর খালিদ বা শারজিল ইমামদের শিক্ষিকা, গণতন্ত্রে ভিন্ন স্বরের অধিকারের প্রবক্তা তনিকা কথা বলছিলেন আরও তিন প্রবীণ ইতিহাসবিদের সঙ্গে। আটলান্টার এমরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্বের অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বিশারদ রোমিলা থাপার। শনিবার রাতে এই আলোচনা আয়োজনের নেপথ্যে ছিল ‘ফ্রেন্ডস অব উমর খালিদ’ বলে একটি মঞ্চ। সংবিধান রক্ষা এবং নাগরিকত্বের সমান অধিকার আন্দোলনের শরিক কিংবা দিল্লির সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনায় সুবিচারের দাবিতে সরব অনিল তেলতুম্বডে, গৌতম নওলাখা, শারজিল ইমাম, উমর খালিদের মতো প্রতিবাদীদের বন্দিদশার পরিপ্রেক্ষিতে নানা কথা উঠে এল সেখানে।
থাপার বলছিলেন, “আসলে দেশ স্বাধীন হলেও দেশবাসীকে প্রজা থেকে নাগরিকের মর্যাদা পেতে লড়তে হয়েছে। লড়তে হচ্ছে।” পার্থের মতে, “রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক অবস্থান গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে খানিক স্বস্তির অবকাশ দিচ্ছে।” তবে ইউএপিএ-সহ বিভিন্ন আইন, যার জোরে নির্বিচারে যে কাউকে বছরের পর বছর জেলে আটকে রাখা যায়, সেই নাগপাশ এখনও এ দেশে স্বাধীন জীবন যাপনের পথে বড় বাধা বলে ইতিহাসবিদেরা মনে করেন। পার্থের কথায়, “জরুরি অবস্থার জন্য দিল্লির শাসকেরা এখনও কংগ্রেসকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। কিন্তু নিজেরা অলিখিত জরুরি অবস্থাই তো চালাচ্ছেন! এই সব কালা কানুনের প্রয়োগকারীরা তদন্ত বা বিচারের পরোয়া করেন না। তার বদলে প্রতিবাদীদের আটকে রেখে নাগাড়ে হয়রানিই হল আসল উদ্দেশ্য।”
অনেকের মতে এর অন্যতম বাস্তব উদাহরণ, প্রবীণ অশক্ত স্ট্যান স্বামী। যিনি মৃত্যু পর্যন্ত এই আইনের ফাঁস থেকে মুক্তি পাননি। জ্ঞানেন্দ্র পান্ডের আক্ষেপ, “স্বরাজ বলতে গান্ধীজি হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, অস্পৃশ্যতা থেকে মুক্তি বা গরিবের হাতে রুটির কথা বুঝতেন। স্বাধীন দেশে আমরা আর্থিক বৃদ্ধি বা সামরিক শক্তি বুঝি! কিন্তু মানুষের কথা আর মনে রাখি না!” এই মানুষের দাবিগুলি মাথা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বলেই প্রকৃত ইতিহাস চর্চা নিয়েও যে এ দেশে আর মাথাব্যথা নেই, তা তুলে ধরলেন থাপার। তিনি বলছিলেন, “এক ধরনের জাতীয়তাবাদী তাড়না থেকেই জেএনইউ পত্তনের সময়ে আমরা বিশ্বসেরা হতে চাইতাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বা ইতিহাস চর্চাই এখন আক্রান্ত। স্বাধীনতার পরিসরটুকু নষ্ট। এটা অসহনীয় ট্র্যাজেডি।” অতীত গরিমার নামে সমকালের রাজনীতিকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা প্রসঙ্গেও রোমিলা বলেন, “ভারতের অতীত আসলে কোনও আখাম্বা মজবুত অনড় নির্মাণ নয়, যা থেকে চাইলেই অনুপ্রেরণার উপাদান সংগ্রহ করা সম্ভব। যাঁরা এই নিয়ে প্রশ্ন করছেন, তাঁদেরও জেলে যেতে হচ্ছে। আবার স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কার লব্জ ‘আজ়াদি’ বা ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’-এর অর্থের অপব্যাখ্যা করেও ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বলা হচ্ছে।”
কালা কানুনের বিরুদ্ধে জেলের ভিতরে-বাইরে প্রতিবাদীদের লড়াই উদ্যাপনেরই যেন স্মারক হয়ে থাকল এ দিন ইতিহাসের
এই আলোচনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy